গাবতলীর বউমেলায় পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ

ইতিহাস ও ঐতিহ্য টাঙ্গাইল জেলা দেশ জুড়ে বিনোদন মিডিয়া রংপুর

বগুড়ার গাবতলীতে ব্যাপক উৎসাহের মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ সন্ন্যাসী ও জামাইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত মানুষ মেলায় এসে কেনাবেচা করেছেন। বিক্রি হয়েছে হরেক প্রজাতির মাছ ও মিষ্টিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে এ মেলার প্রধান আকর্ষণ বাঘাইর মাছ প্রকাশ্যে কেনাবেচা হয়নি।

 

বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) গোলাবাড়ি বাজার এলাকায় ‘‘বউমেলা’’ অনুষ্ঠিত হবে। প্রথা অনুযায়ী এতে শুধু নারী ক্রেতা-বিক্রেতা থাকবেন। বুধবার দুপুরে বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে পোড়াদহ মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন বয়স ও ধর্ম-বর্ণের শত শত নারী-পুরুষের উপচে পড়া ভিড়। মেলায় বাঘাইর প্রকাশ্যে বিক্রি না হলেও বড় বড় চিতল, ভেউস, বোয়াল, রুই, কাতলা, সিলভার কার্পসহ নানা প্রজাতির মাছ তোলা হয়। কারো কাছে মাছের বাজার সস্তা আবার কেউ কেউ বলছেন চড়া। আকার ও ওজনভেদে কাতল ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা, বিগহেড ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা, সিলভার কার্প ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, বোয়াল ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা, চিতল ১,৪০০ থেকে ১,৫০০ টাকা, গ্লাস কার্প ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, পাঙ্গাস ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা, রুই ৪০০ থেকে ১,০০০ টাকা এবং আইড় মাছ ১,৫০০ থেকে ১,৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

 

টাঙ্গাইলের শরীফ তালুকদার নামে এক ব্যবসায়ী কক্সবাজার থেকে প্রায় ৪০ কেজি ওজনের একটি পাখি মাছ এনেছিলেন। তিনি প্রতি কেজি ১,৫০০ টাকা দাম হাঁকেন। শরীফ দাবি করেন, এটি মেলার সেরা মাছ। পরে তাকে দেখতে না পাওয়ায় মাছটি কত দামে বিক্রি হয়েছে তা জানা যায়নি। স্থানীয় সন্ন্যাসী পূজা উপলক্ষে দুই শতাধিক বছরের পুরানো মেলায় ছিল প্রশাসনের কঠোর নজরদারি। মেলায় মাছ ছাড়াও হরেক রকম মিষ্টি বিক্রি হয়। বগুড়ার গাবতলীর পীরগাছা এলাকার অনিক মিষ্টি ভান্ডারের মালিক মহিদুল ইসলাম জানান, তিনি ১১ কেজি ওজনের ‘‘মাছ মিষ্টি’’ বিক্রি করেন ৪০০ টাকা কেজি দরে। মেলায় ২০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরের কয়েক মণ মিষ্টি বিক্রি হবে বলে আশা ব্যবসায়ীদের। এছাড়া কাঠ ও স্টিলের আসবাবপত্র, বরই, কৃষি সামগ্রী, গোশত, হরেক রকম আচার, মিষ্টান্ন বিক্রি হয়েছে। শিশুদের খেলনা ছাড়াও চিত্তবিনোদনের জন্য বিচিত্রা, সার্কাস, যাদু, নৌকা ও নাগরদোলা ছিল। তবে মেলায় অতি গোপনে জুয়া চলেছে।

 

 

স্থানীয় প্রবীণরা জানান, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রায় ২০০ বছর ধরে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ী বন্দর সংলগ্ন ইছামতি নদীর তীরে জমিতে সন্ন্যাসী পূজা করে আসছেন। বাংলা পঞ্জিকার মাঘের শেষ বা ফাল্গুনের প্রথম বুধবার মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ একদিনের মেলায় কেনাকাটা করতে আসেন। লাখ লাখ টাকার মাছ, মিষ্টি, আসবাসপত্রসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয়ে থাকে। ঈদে সম্ভব না হলেও পোড়াদহ মেলার সময় আত্মীয়দের দাওয়াত করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মেলাকে ঘিরে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের বাড়িতে মেয়ে, জামাই ও নাতি-নাতনিরা এসে ভড়ে গেছেন। তাদের মেলার মাছ, মাংস, কাঁচা শাকসবজিসহ বিভিন্ন খাবার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি হরেক রকম পুলিপিঠাও রয়েছে। অনেক জামাই মেলা থেকে সাধ্যমত মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে ফেরেন।

মেলায় আগত সিরাজগঞ্জ সদরের ব্যবসায়ী মোকছেদ আলী জানান, তারা প্রতি বছরের মত বন্ধুরা মিলে পোড়াদহ মেলায় এসেছেন। দিনভর খাওয়া-দাওয়া শেষে বড় মাছ কিনে বাড়িতে ফিরবেন।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে আসা ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ জানান, তিনি ঈদে সম্ভব না হলেও পোড়াদহ মেলার আগে স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এলাকার শ্বশুরবাড়িতে আসেন। শ্বশুরবাড়ির জন্য ১২ কেজি ওজনের বড় সিলভার কার্প মাছ কিনেছেন।

বগুড়া শহর থেকে আসা গণমাধ্যমকর্মী আলমগীর হোসেন, ব্যাংকার মিজানুর রহমান, এনজিওকর্মী সুজন সাকিদার প্রমুখ জানান, তারা প্রতি বছর পোড়াদহ মেলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। তারা বড় বড় মাছ, মিষ্টান্ন, হরেক রকম আচার দেখতে ও খেতে আসেন। মেলা একদিনের হলেও এর আমেজ থাকে সপ্তাহজুড়ে। মেলাটি জন্মের পর থেকে মহিষাবান গ্রামের মন্ডল পরিবার পরিচালনা করে আসছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মেলার লাইসেন্স দেওয়া হয়। এবার মেলার নেতৃত্বে ছিলেন মন্ডল পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় মহিষাবান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ মন্ডল। আব্দুল মজিদ মন্ডল জানান, প্রশাসনসহ এলাকাবাসীর সহযোগিতায় শান্তিপূর্ণভাবে মেলা সম্পন্ন হয়েছে।

গাবতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।

তিনি আরও জানান, বৃহস্পতিবার সকালে গোলাবাড়ী বাজার এলাকায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জাহিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে বউ মেলা অনুষ্ঠিত হবে। এ মেলায় পুরুষদের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিভিন্ন বয়সের নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করে থাকেন। প্রায় ২৪ বছর ধরে বউ মেলা হয়ে আসছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *