সম্মেলনে খান ও সিদ্দিকী পরিবারের পতনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ শুরু
পরিবারতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত অবস্থায় টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিল ও সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সোমবার থেকে জেলার আওয়ামী রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ শুরু হয়েছে। গত কয়েক বছরে প্রভাবশালী খান ও সিদ্দিকী পরিবারের বিদায় ঘন্টার শেষ পেরেকটি মারা হয়েছে রোববারের জেলা সম্মেলনের মাধ্যমে। সরাসরি ভোট না হলেও ৪৩৯জন কাউন্সিলরের অধিকাংশই স্বতস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানিয়েছেন নয়া সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহেরকে। এ সম্মেলন টাঙ্গাইল জেলার আওয়ামী রাজনীতির জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে ভাবছেন কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরা। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর নয়া নেতা পেয়ে বেজায় খুশি আওয়ামী ঘরাণার নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।
স্বাধীনতার পর এই প্রথম টাঙ্গাইলের আওয়ামী রাজনীতিতে খান ও সিদ্দিকী পরিবারের প্রত্যক্ষ প্রভাবমুক্ত পরিবেশে সফল, স্বার্থক, বর্ণাঢ্য ও ডিজিটাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনের পর এই প্রথম জেলা পর্যায়ে এতো বড় আয়োজনের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠ পরিবেশে সফল সম্মেলন করতে পেরে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা এবং জেলার কর্মী-সমর্থকরা। সম্মেলনে আসা বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও সঠিক সিদ্ধান্তের ফলে আজ দলের দুষ্ট ও সন্ত্রাসীরা দূর হয়েছে। সন্ত্রাসীদের আওয়ামী লীগে কোন স্থান নেই তা নেত্রী আবারও প্রমাণ করলেন। শেখ হাসিনার নির্দেশে জেলা আওয়ামী লীগের নতুন দায়িত্বে এসেছেন, সভাপতি পদে বর্ষিয়ান নেতা ফজলুর রহমান খান ফারুক এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ত্যাগী নেতা অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহেরকে।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিটি সম্মেলনেই টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত সিদ্দিকী এবং খান পরিবারের আধিপত্যের প্রতিযোগিতা চলে আসছিল। গত বছর সিদ্দিকী পরিবারের বড় ছেলে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী নিউইয়র্কে হজ নিয়ে বেফাঁস বক্তব্য দিয়ে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন, দল থেকেও বহিস্কৃত হয়েছেন। পরে তিনি সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর আগে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম দল থেকে বের হয়ে নিজে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে একটি দল গঠন করেন। কাদের সিদ্দিকীর সাথে তাঁর ছোট ভাই আজাদ সিদ্দিকী রাজনীতি করছেন। অপর ভাই মুরাদ সিদ্দিকী দুইবার সদর আসনে (টাঙ্গাইল-৫) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা সত্বেও পরাজিত হয়েছেন। এ পরিবারের কনিষ্ঠ ভাইদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজির অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ লতিফ সিদ্দিকীর দল থেকে বহিস্কৃত হওয়ার মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইল জেলার আওয়ামী রাজনীতিতে সিদ্দিকী পরিবারের অবসান ঘটে।
অন্যদিকে, প্রভাবশালী খান পরিবারের কর্ণধার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শামসুর রহমান খান শাজাহান বিগত ২০১২ সালে ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীতে শামসুর রহমান খানের ভাতিজা আমানুর রহমান খান রানা টাঙ্গাইল-৩(ঘাটাইল) আসনের উপ-নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। অপর ভাতিজা সহিদুর রহমান খান মুক্তি টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। আরেক ভাতিজা জাহিদুর রহমান খান কাঁকন জেলার পরিবহন ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ পদ দখলে নেন। এছাড়া এদের ছোট ভাই সানিয়াত খান বাপ্পা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি পদ লাভ করেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তারা এ পদগুলো লাভ করেন। তারা চার ভাই টাঙ্গাইলে খান পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ‘সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করেন। পৃথক বিচারালয়, ভুমি জবর দখল ও টর্চার সেলও গঠন করেন তারা। সকল সামাজিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনে তাদের মনোনীতদের বসিয়ে অলিখিত রাজত্ব শুরু করে। ‘খান সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তারা জেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন।
তারা প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরনো পতিতাপল্লী উচ্ছেদ করে জমি দখলের চেষ্টা, হত্যার অভিযোগ, জেলা সমবায় মার্কেট পূণনির্মাণের নামে ব্যবসায়ীদের পথে বসানো সহ নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েন। জেলায় চাঁদাবাজির মাত্রা এতটাই বিস্তৃত হয় যে ‘ডিম’ থেকেও ১৫% হারে চাঁদা আদায় শুরু করে। সর্বশেষ তারা চার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে আত্মগোপণে চলে যায়। প্রায় এক বছর ধরে তারা আত্মগোপণে রয়েছেন। এজন্য শুধুমাত্র চার ভাইয়ের বাবা আতাউর রহমান খান সম্মেলনে দর্শক সারিতে উপস্থিত থাকলেও কোন ভূমিকায় দেখা যায়নি। এছাড়া খান পরিবারের অন্য কোন সদস্য বা প্রত্যক্ষ কোন প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। জেলায় এর আগের সম্মেলনগুলোতে এরা প্রত্যক্ষভাবে মঞ্চে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ সম্মেলনের মাধ্যমে জেলার আওয়ামী রাজনীতিতে ‘খান সাম্রাজ্য’র পতন হলো বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
জেলার এ দু’টি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের প্রভাবমুক্ত হয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে সম্মেলন আয়োজন করায় জেলার সাধারণ নেতাকর্মীরা সকল ভয়ভীতির উর্দ্ধে থেকে উৎসব আমেজে জেলার সফল সম্মেলনে অংশ নেন। সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে দলীয় আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত বন্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগে চক্রান্তকারীদের কোন জায়গা নেই। দলে থেকে যে বা যারা দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত মানতে চিন্তা-ভাবনা করে, তারা দলের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী খান পরিবারকে ইঙ্গিত করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, এক সময় শোনা যেতো একটি পরিবার না থাকলে নাকি টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগ অচল হয়ে পড়বে। আজ তারা নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী স্বতস্ফূর্তভাবে আজকের এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছে, সফল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মন্ত্রী টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ ফারুক আহমদকে স্বরণ করে আরও বলেন, তাঁর মতো ত্যাগী নেতা দ্বিতীয়টি টাঙ্গাইলে জন্ম নেবে না। জেলা আওয়ামী লীগের সকল কাজে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। রোববার অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনের প্রথম পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য তিনি একথা বলেন। টাঙ্গাইল আউটার স্টেডিয়াম অনুষ্ঠিত দিনব্যাপি সম্মেলনে ও এর আশপাশে প্রায় ৫০ হাজার নেতা-কর্মী ও সমর্থকের সমাগম ঘটে।