মির্জাপুরে ২৮টি খাল ও বিল দখল ॥ শতশত একর জমির ধান পানির নিচে

158

এসএম এরশাদ, মির্জাপুর ॥
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কয়েকটি ইউনিয়নে শতশত একর বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে আছে। উপজেলার ২৮টি খাল ও বিল ভরাট করে দখল করায় এবং অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ ও স্থাপনা নির্মাণ করায় মির্জাপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে কৃষকের আবাদ করা শতশত একর জমির পাকা ও আধাপাকা বোরো ধান বৃষ্টির পানির জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে। অনেক কৃষক লোকসানের আশঙ্কায় জমির ধান কাটছেন না। এতে ওইসব কৃষকের জমির পাকা ধান পানির নিচেই নষ্ট হচ্ছে। এই জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিবছর ফসলহানি ঘটে কৃষক ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হলেও প্রতিকার করতে কেউ এগিয়ে আসছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে খালের প্রবাহ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে একদিকে যেমন সময়মত ফসল রোপণ করতে পারে না কৃষক। অন্যদিকে ফসল ফলিয়েও তা ঘরে তুলতে পারেন না বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
মির্জাপুর কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় সবচেয়ে বড় কৃষি আবাদ হচ্ছে বোরো চাষ এবং দ্বিতীয় বৃহত্তর আবাদ হচ্ছে সরিষা আবাদ। চলতি বছর ২০ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। অন্যদিকে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রায় ৮ হাজার হেক্টর।
উপজেলা সদরের পুষ্টকামুরী, ভাতগ্রাম ইউনিয়নের সিঞ্জুরী ও দুল্যা বেগম গ্রামে সরেজমিনে দেখা গেছে, শতশত একর জমির বোরো ধান বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে কোমর পানিতে নেমে আধা পাকা ধান কেটে নিচ্ছেন। আবার কোন কোন কৃষক জমির ধান কেটে কলাগাছের ভেলায় পারে আনছেন। এতে তাদের দ্বিগুন খরচ হচ্ছে।
এ উপজেলার আজগানা ইউনিয়নের ভুলোয়া-গুল্লার খাল, খাটিয়ারহাট, লতিফপুর ইউনিয়নের চানপুর খাল, টেংরাপাড়া বিল, কোনাইবিল, সলিমনগর খাল, মির্জাপুরের শিল্পাঞ্চল এলাকা গোড়াই ইউনিয়নের লালবাড়ি খাল, কোদালিয়া খাল, সোহাগপাড়া (শিকদারপাড়া) খাল, গোড়াই খাল, সৈয়দপুর বাকালীপাড়া খাল, বামনটেকী খাল, নগরের খাল, ভেকাই বিল, কচুয়াপাড়া, পালপাড়া জেইলা বিল, ফতেপুর ইউনিয়নের শুভূল্যা খাল, বারকাঠি বিল, পৌর এলাকার পুষ্টকামুরী খাল, আন্ধরা খাল, বারোখালী খাল, ভাওড়া ইউনিয়নের চামুটিয়া খাল, নিধিবাড়ী খাল, জামুর্কী ইউনিয়নের গুনটিয়া খাল, সাটিয়াচড়া খাল, বানাইল ইউনিয়নের ভররার খাল, ভাইয়াকুড়া বিল, ভাতগ্রাম ইউনিয়নের বাগজানের খাল স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দুই পাশ থেকে দখল নিয়ে ভরাট করে ড্রেনে পরিণিত করেছেন।
নিধিবাড়ী-বর্ধনপাড়া-কেশবপুর খালটি সচল না থাকায় সিঞ্জুরী বিলের বর্ষার পানি দীর্ঘদিন জমে থাকে। এতে সরিষা ও বোরো আবাদ ১৫ দিন থেকে একমাস পিছিয়ে যায়। কৃষক সরিষা তুলে বোরো চাষ করলে ধান পাকার আগেই তা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। একইভাবে এবারও এ এলাকার শতশত একর বোরো জমির ধান বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে বলে ওই এলাকার কৃষকরা জানিয়েছেন। নিধিবাড়ী খালটি সিঞ্জুরী বিল হতে বর্ধন পাড়া, রোয়াইল, চামুটিয়া ও কেশবপুর হয়ে বহুরিয়া নদীর পূজাঘাটে মিলেছে বলে ওই এলাকার লোকজন জানিয়েছেন।
উপজেলার আজাগানা ইউনিয়নের ভুলোয়া-গুল্লার খাল দুইপাশ থেকে প্রভাবশারীরা দখল করে ৪/৫ফুটের ড্রেনে পরিণিত করা হয়েছে। এছাড়া খাল দখল করে ইট ভাটা নির্মান করে মাটি ভরাট করায় খালের পানি প্রবাহ বন্ধ রয়েছে। এ কারণে ওই ইউনিয়নের হাজার হাজার একর জমির ধান পানির নিচে উল্লেখ করে খালটি দখলমুক্ত করার জন্য ইউনিয়নের বেলতৈল, ঘাঘড়াই, কুড়াতলী ও লতিফপুর ইউনিয়নের চানপুর গ্রামবাসী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এছাড়া ওই অভিযোগটি স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি), মির্জাপুর থানা, সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও মির্জাপুর প্রেসক্লাবে অনুলিপি দিয়েছেন।
আজগানা ইউনিয়নের বেলতৈল গ্রামের আনোয়ার হোসেন, বেলায়েত হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, ইয়াকুব, আসাদ ছানো, সালামসহ অনেকেই টিনিউজকে জানান, খালটি ঘাঘড়াই কুড়াতলী থেকে শুরু হয়ে ভুলোয়া হয়ে বেলতৈল গ্রামের ভেতর দিয়ে বংশাই নদীতে মিলিত হয়েছে। দীর্ঘ চার কিলোমিটার এই খালটি কোন কোন জায়গায় ৪শ ফুট পাশ ও সর্বনিন্ম ১শ ফুট পাশ ছিল। বর্তমানে খালটির দুইপাশ থেকে দখল হয়ে ৪/৫ ফুটের একটি ড্রেনে পরিণিত হয়েছে। আশপাশের গ্রামের পানি নিস্কাশনের একমাত্র খাল এটি। সরকারি কর্মকর্তারা নকমা নিয়ে পরিমাপে এসে খালটির কোন চিহ্ন পাবে না বলে তারা অভিযোগ করেন।
সিঞ্জুরী গ্রামের কৃষক বদর মিয়া, চান মিয়া ও কৃষ্ণ সরকার টিনিউজকে বলেন, বর্ধন পাড়া-নিধিবাড়ী খালটি এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ভরাট করে দখল করায় এ এলাকার কৃষক প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ক্ষতিগস্ত হচ্ছে। আমাদের এত বড় সমস্যায় কেউ এগিয়ে আসছেনা।
পৌর এলাকার পুষ্টকামুরী গ্রামের বাসিন্দা উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি সাবেক ভিপি আবু আহমেদ টিনিউজকে জানান, আশপাশের খাল-বিল দখল হওয়ায় পানি নিস্কাশন হতে পারছে না। গ্রামের বিলের পাশে তার প্রায় ৬০ শতাংশ জমির পাকা ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ৬/৭শ টাকা করে শ্রমিক। পানির নিচ থেকে ধান কেটে আনতে যে পরিমান টাকা খরচ হবে তা ধান বিক্রি করেও দেয়া সম্ভব নয়। এ কারণে তিনি ধান কাটছেন না বলে জানান।
ভাওড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন টিনিউজকে বলেন, নিধিবাড়ী খালটি কেশবপুর এলাকায় ভরাট হওয়ায় তার ইউনিয়নের চানপুর, ভাওড়া, হাড়িয়া ও পাইখার এলাকার কৃষক জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ বছরও বিপুল পরিমাণ বোরো ধান তলিয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মহেড়া ইউনিয়নের কুমুল্লি বিলে আবাদ করা বোরো কৃষকরা। মির্জাপুর উপজেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি আব্দুল খালেক টিনিউজকে বলেন, বিল সংলগ্ন শুভুল্যা খালের মাথায় ভরাট হওয়ায় এবং লৌহজং নদী সংলগ্ন সারুটিয়া একলাকায় খালের মধ্যে উচু করে কংক্রিট বাধ দিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করায় স্বাভাবিকভাবে পানি চলাচল করতে পারে না। একইভাবে হাড়ভাঙ্গা খালটিও দুষ্টচক্র ভরাট করে ফেলেছে। এতে বিলটিতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে কৃষকের সরিষা ও বোরো আবাদ ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এবারও কৃষকের অনেক বোরো ধান বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে বলে আবদুল খালেক উল্লেখ করেন।
এছাড়া গ্রামাটিয়া এলাকায় ভররার খালের মাথা ভরাট করায় ভাইয়াকুড়া বিলের শতশত একর জমির বোরো ধান বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে তলিয়ে গেছে বলে বানাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন ফারুক খান টিনিউজকে জানিয়েছেন।
পুষ্টকামুরী গ্রামের কৃষক হাজী হায়দার হোসেন টিনিউজকে জানান, বৃষ্টির পানিতে তার প্রায় ৩ একর জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ধান পানির নিচে থাকায় শ্রমিকের মুজুরিও বেশি। জমি থেকে ধান কেটে পারে আনতে শ্রমিকদের সুবিধার্থে তিনি কলাগাছের ভেলা বানিয়ে দিয়েছেন বলে জানান।
মির্জাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মশিউর রহমান টিনিউজকে বলেন, জলাবদ্ধতা থেকে কৃষকের ফসল রক্ষার জন্য ভরাট হওয়া খাল খনন ও ড্রেন নিমাণের জন্য প্রশাসন থেকে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত সাদমীন টিনিউজকে বলেন, অভিযোগটি এখনও হাতে পাইনি। পেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।