বড় পর্দায় ঈদের সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত টাঙ্গাইল সিনেমা প্রেমী দর্শকরা

0 295

মোজাম্মেল হক ॥
বড় পর্দায় ঈদের সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত টাঙ্গাইল সিনেমা প্রেমী দর্শকবৃন্দ। এবার ঈদে প্রায় ১১টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। টাঙ্গাইলের মানুষ কিন্তু এই বিনোদনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কারন বর্তমানে টাঙ্গাইল শহরে বড় পর্দায় সিনেমা দেখার কোন সিনেমা হল নেই। শহরে এক সময়ের ৫টি সিনেমা হল ধীরে ধীরে ভেঙে ফেলে সেখানে শপিং কমপ্লেক্স কিংবা মার্কেট করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে ডিসেম্বর মাসে শহরের মিয়া পাড়ায় অবস্থিত মালঞ্চ সিনেমা হলটি ভেঙে মানুষের বসবাসের জন্য “মালঞ্চ টাওয়ার” বানানো হচ্ছে।
জানা যায়, ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ফিল্ম ফেডারেশন কর্পোরেশন (এফডিসি) সারাদেশে ঈদের ছবি মুক্তি পাচ্ছে সাকিব খানের আমিই লিডার বাংলাদেশ, অনন্ত জলিলের কিম হিম, প্রেমপ্রীতির আদর আজাদ ও ববুলীর লোকাল, সজল ও পুজাচেরীর জ্বিন, জিয়াউল রোশনের ও ববির পাপ, বাংলার হারকিউলিস, ময়নার শেষ কথা, অপু বিশ্বাস ও সাইমন সাদিকের লাল শাড়ী, সিয়ামের অর্ন্তজাল, রায়হান রাফির নুর, ছুটকু আহমেদ পরিচালিত আগুন ও হিরো আলমের টোকাই। টাঙ্গাইল শহরের মালঞ্চ সিনেমা হলটি ভেঙে ফেলার পর বড় পর্দার বিনোদনের মাধ্যম সিনেমা হল মুক্ত এখন টাঙ্গাইল শহর। যদিও টাঙ্গাইল সদরের বাইরে মধুপুর উপজেলা, সখিপুর উপজেলা ও নাগরপুর উপজেলায় ১টি করে সিনেমা হল এখনও জীবিত আছে। অনেকটা কোনমতে বেঁচে থাকার মতো বেঁচে আছে। মাসে মাসে বড় ধরনের লোকসান শুনে মধুপুরের মাধবী ও নাগরপুরের ডিজিটাল রাজিয়া সিনেমা হল ২টি টিকে আছে সরকারের কাছে কিছু অনুদানের আশায়। হয়ত আশায় শুড়েবালি দিয়ে জেলার সর্বশেষ সিনেমা হল ২টি হারিয়ে যাবে শপিং মলের আড়ালে।




কারন সিনেমার ব্যবসা এখন আর নাই, মানুষ আর আগের মতো দল বেঁধে বড় পর্দার সিনেমা হলে যায় না। দেখা যায় না সিনেমার টিকিট ক্রয়ের সেই ভীড় কিংবা সিনেমা হলে প্রবেশের মুহুর্তে লম্বা লাইন। সিনেমা হলে বসে তিন ঘন্টার মতো সময় ব্যয় করে বিনোদনে ডুবে থাকার সময় কই? বিনোদনের বর্তমান বড় মাধ্যম মোবাইল থাকলে আর কিছু লাগে না। মোবাইল সিনেমা হলের থেকে অনেক অনেক বিনোদন চাহিদা পূরণ করতে পারে। অনলাইনের যুগে মোবাইলে সিনেমা দেখা, গান দেখা, গেমস খেলা, কথা বলা ও মন চাইলে ছবিসহ ভিডিও করা সবকিছুই সম্ভব। যদিও ভালো মানের সিনেমা তৈরী হলে কিছু দর্শক সেই সিনেমা দেখতে বড় হলে যায়। কিন্তু সেই ভালো মানের সিনেমা এখন আর তেমন তৈরী হয় না। বছরে একটা থেকে দুটি ভালো মানের সিনেমা এ শিল্পকে ধরে রাখতে পারবে না। ডিজিটাল যুগে দর্শকের নিত্য নতুন কিছু চাই। আর নিত্য নতুন কিছু পূরণ সম্ভব না হওয়ায় জেলায় জেলায় ধসে পড়ছে সিনেমা হলগুলো। সীমাহীন লোকসান আর নানা শঙ্কায় সিনেমা হল ভেঙে হল মালিকরা শপিং মল কিংবা বাসস্থানের টাওয়ার তৈরী করছেন।




টাঙ্গাইল জেলায় এক সময় ৩৯টি সিনেমা হল ছিল। টাঙ্গাইল শহরে ছিল ৫টি সিনেমা হল- সেগুলি হল রওশন টকিজ সিনেমা হল, রুপসী সিনেমা, রুপবানী সিনেমা, মালঞ্চ সিনেমা ও কেয়া সিনেমা। টাঙ্গাইল শহরের বাইরে করটিয়া ইউনিয়নে ছিল ফরিয়া ও নন্দিনী সিনেমা হল। ঘাটাইলে জনতা, একতা, কনক ও রুপালী সিনেমা হল। কালিহাতীর বল্লাবাজারে শাহিন, তাহেরা ও আলোছায়া সিনেমা হল। দেলদুয়ারের পাথরাইলে চৌধুরী টকিজ ও আশা সিনেমা হল। এলাসিনে কোহিনুর সিনেমা হল। গোপালপুর উপজেলায় উত্তরা, কাকলী সিনেমা হল। মির্জাপুরে মিতালী ও পাকুল্লায় সোলার সিনেমা হল। ধনবাড়ী উপজেলায় অনামিকা, মধুসন্ধ্যা প্রিয়াসী সিনেমা হল। ভূঞাপুরে রেখা সিনেমা হল। মধুপুরে মাধবী, বানী, কল্লোল, রেনাজ, রিফাত, সৌখিন ও ভাই ভাই ও সীমাসহ ৮টি সিনেমা হল, নাগরপুর উপজেলায় রজনী সিনেমা, রাজিয়া ও ফাল্গুনী সিনেমা হল। মির্জাপুরের জামুর্কি সিনেমা হল, বাসাইলের রেশমী সিনেমা হল।




বর্তমানে মধুপুরে মাধবী ও নাগরপুরের রাজিয়া সিনেমা হল চলমান রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে কোন মুহুর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আরও জানা যায়, পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বই দশকের মধ্যে টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় ৫১টি সিনেমা হল গড়ে উঠে ছিল। বিগত ১৯৬৪ সালে টাঙ্গাইল শহরের কলেজ পাড়ার বাসিন্দা মন্টু চৌধুরী তার স্ত্রী আনোয়ারা চৌধুরীর উৎসাহে শহরের মেইন রোডে তিন তলার চমৎকার ডিজাইনে ভবন নির্মাণ করে নাম দেন নীলাগ সিনেমা হল। যদি কিছুদিন পর নাম পরিবর্তন হয়ে রুপবাণী সিনেমা হল নামধারন করে। যা এখন বন্ধ অবস্থায় ময়লা আর্বজনার চেহারা নিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। বিগত ২০১৪ সালে দিকে সিনেমার বাজার মন্দার পাশাপাশি সিনেমা হলটি মালিকানা বিরোধে হলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ বড় ধরনের বৈদ্যুতিক বিল বাকী পড়ে যাওয়া।
জানা যায়, ১৯৭২ সালে শহরের কলেজ পাড়ায় বর্তমান আর্টিজেন্স অফিসের পাশে টিনের গুদাম ঘর ভাড়া নিয়ে কালী সিনেমা হল চালু করা হয়। টাঙ্গাইল শহরের ভিক্টোরিয়া রোডের শেষ মাথায় নিরালা মোড়ের করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাবের জমি লিজ নিয়ে রওশন টকিজ সিনেমা হল নির্মান করেন মরহুম লেবু চৌধুরী। করোনেশন ড্রামাট্রিক ক্লাবের লিজ বন্ধ হলে বিগত ২০০৪ সালে সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায়। বিগত ১৯৭৩ সালে শহরের বটতলায় নিজ জমিতে লেবু চৌধুরী নির্মাণ করেন রুপসী সিনেমা হল। এরপর একই মালিকানায় তিনি ধনবাড়ী, মির্জাপুর ও দেলদুয়ারের পাথরাইলে আরো ৩টি সিনেমা হল নির্মান করেছিলেন। বিগত ২০১১ সালে সীমাহীন লোকসানের কারনে রুপসী সিনেমাটি বন্ধ হয়ে যায়। বিগত ১৯৭৫ সালে ছানা মিয়া শহরের মিয়াপাড়ায় নির্মান করেন মালঞ্চ সিনেমা হল এবং ১৯৭৬ সালে আদালত পাড়ায় আফজাল চৌধুরী নির্মান করেন কেয়া সিনেমা হল। বিগত ২০১৯ সালে জানুয়ারী মাসে তার ছেলে ফিরোজ চৌধুরী সিনেমা হলটি বন্ধ করে দেন।




এছাড়া টাঙ্গাইল সদরের করটিয়া ইউনিয়নে ফরিয়া ও নন্দিনী নামে দুটি সিনেমা হল ছিল, যা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। টাঙ্গাইলে সিনেমাপ্রেমী দর্শকরা অপেক্ষায় আছে, টাঙ্গাইল শহরে একটা উন্নতমানের সিনেপ্লেক্স নির্মান হবে। হয়ত এই সিনেপ্লেক্সের মাধ্যমে ভেঙে পড়া সিনেমা শিল্প জীর্ণ অবস্থায় টিকে থাকবে! সেই আশায় রুচিশীল সিনেমাপ্রেমী দর্শকরা।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.

ব্রেকিং নিউজঃ