তীব্র গ্যাস সংকটে মির্জাপুরের গোড়াই শিল্পাঞ্চল ॥ উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে

111

হাসান সিকদার ॥
তীব্র গ্যাস সংকটে দেশের অন্যতম টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই শিল্পাঞ্চল এলাকায়। এতে প্রায় অর্ধশত কলকারখানায় উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস সংকটে এ অবস্থায় শিল্প উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় মিলকারখানায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে। সময়মত উৎপাদন না হওয়ায় রপ্তানিকারকরা ক্রয়াদেশ বাতিলের আশঙ্কা করছেন। গোড়াই শিল্পাঞ্চল এলাকায় গ্যাস পাইপলাইনের চাপ সকালে ৩ থেকে ৪ পিএসআইয়ের (প্রেসার পার স্কয়ার ইঞ্চি) নিচে নেমে যায়। এতে দিনের বেলায় বেশিরভাগ কারখানায় গ্যাসের প্রেসার থাকে না। তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, নিটিং কারখানাগুলোর সক্ষমতা থাকা সত্বেও উৎপাদন না থাকায় তারা আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছে। সংকট চরম আকার ধারণ করছে।




গোড়াইয়ে অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প কারখানার ব্যবস্থাপকরা টিনিউজকে জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক সংলগ্ন গোড়াই শিল্পাঞ্চলে ছোট বড় মিলে প্রায় অর্ধ শতাধিক মিলকারখানা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ২০টি সিএনজি স্টেশন। এসব কারখানায় প্রায় ৫০-৬০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সাধারণত জেনারেটর বা বয়লার চালানোর জন্য এসব পোশাক কারখানাগুলোয় ১৫-১৬ পিএসআই গ্যাস চাপের প্রয়োজন। কিন্তু গ্যাসের চাপ ৪-৫ পিএসআইয়ে নেমে এসেছে। এ চাপে কোনোভাবেই গ্যাসচালিত মেশিন চালানো যাচ্ছে না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সকালের দিকে। দুপুরের পর থেকে চাপ কিছুটা বাড়তে থাকে। গ্যাস না থাকায় প্রতিদিন কোটি টাকার পণ্য উৎপাদনে চরম ব্যঘাত ঘটছে।
এতে করে রপ্তানিমুখী বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখে পড়েছে। গ্যাস না পেয়ে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেলের ব্যবহার বাড়ায় কারখানাগুলোয় পণ্যের উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাতে গ্যাসের চাপ পাওয়া গেলেও সারা দিন কম থাকে। এর ফলে কোনো কোনো কারখানার একটি ইউনিট কোনোমতে চালানো সম্ভব হলেও গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় পুরোপুরি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। ছোট ও মাঝারি মানের অধিকাংশ কারখানাই গ্যাসের অভাবে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তাঁরা টিনিউজকে আরও জানান, গ্যাসের এই তীব্র ঘাটতি দ্রুত মেটানো না গেলে অর্থনীতি ও বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় মেশিনারিজের ক্ষমতার মাত্র অর্ধেক ব্যবহার করা হচ্ছে।




গোড়াই হামীম গ্রুপের এক্সপ্লোর গার্মেন্টস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার কদ্দুসউল আলম টিনিউজকে বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় তিন হাজার শ্রমিক কাজ করে। তৈরী পোষাক বিদেশে রপ্তানী করে শতভাগ বৈদেশীক মুদ্রা অর্জন করছে। এতে করে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছি। কিন্ত গ্যাসের চাপ স্বল্পতার কারণে কারখানা পুরোপুরি চালু করা যাচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে কারখানার উৎপাদন মারাত্বকভাবে ব্যহত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানটি লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনছে। গ্যাসের সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যহত হওয়া সত্বেও শ্রমিক কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা সঠিক সময়ে নিয়মিত প্রদান করা হচ্ছে। সময়মত উৎপাদন না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে মালামাল সরবরাহ করতে না পারার কারণে ক্রয়াদেশ বাতিল হচ্ছে। তাই দেশীয় শিল্প টিকিয়ে রাখতে বৈদেশীক মুদ্রা অর্জন অব্যহত রাখা এবং হাজার হাজার শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ বজায় রাখার স্বার্থে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে নাহিদ কটন মিলস লি. এবং ডেলসি কটন স্পিনিং মিলস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) ফারুক হোসেন টিনিউজকে বলেন, কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ক্রয়াদেশ এমনিতেই কমে যাচ্ছে। সেখানে যেসব ক্রয়াদেশ আসছে তা-ও যদি সময়মতো শিপমেন্ট না করা যায় তাহলে তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। গোড়াই শিল্প এলাকায় ১৫০ ফিডার লাইনে গ্যাসের চাপ পাওয়া যাচ্ছে না। এলএনজির দাম বাড়ানো হলেও গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ বাড়েনি। গ্যাসের সংকট থাকায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে প্রতি মাসে তাদের কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।




একই অভিযোগ করেছেন, ইমপ্রেস ইনটেক্স, উত্তরা স্পিনিং মিলস, টেকনো স্পিনিং মিলস, কম্পিট কম্পোজিট, সাউথ ইস্ট টেক্সটাইল ও নিউটেক্স গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তা এবং পরিচালকরা। হাজার হাজার লোকের জীবিকা নির্বাহ টিকিয়ে রাখতে হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার দাবি জানান তাঁরা। উত্তরা স্পিনিং মিলসের প্রকল্প পরিচালক বিধান সরকার টিনিউজকে বলেন, গ্যাস সংকটের কারনে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে কারখানা গুলো চলছে। এলএনজি আমদানি কম হলেই কারখানার উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। এলএনজি আগে ছিল ১৬ টকা এখন ৩০ টাকা। তারপরও প্রয়োজনমত সরবরাহ করা যাচ্ছে না। যেমন আমদের প্রতি ঘন্টায় ১৫শ কিউবেক মিটার গ্যাসের প্রয়োজন। কিন্তু আমি পাচ্ছি ৪শ’ থেকে ৫শ’ কিউবেক মিটার। যা প্রয়োজনের তুলনায় একবারেই অপ্রতুল। এতে করে উৎপাদন না হওয়ায় কোটি কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
টাঙ্গাইল তিতাস গ্যাস সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে তিন হাজার দুইশ’ মিলিয়ন থেকে তিনশ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে দুই হাজার চারশ’ থেকে পাঁচশ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় আটশ’ থেকে নয়শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। যা দেশের জেলাগুলোতে সমন্বয় করা হয়।




টাঙ্গাইল তিতাস গ্যাস টান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম টিনিউজকে বলেন, প্রতিদিন তাদের গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। টাঙ্গাইলে তাদের প্রতিদিন প্রয়োজন ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। তারা পাচ্ছেন ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় তাদের হিমশিম খেতে হয়। সকালে সব এক সাথে শিল্পকারখানা সিএনজি স্টেশন ও আবাসিকে এক সাথে কাজ শুরু হওয়ায় সকালে গ্যাসের চাপ কম থাকে। দুপুরের পরই কিছুটা চাপ বৃদ্ধি পায়। গোড়াই এলাকার শিল্পের মালিকদের পক্ষ থেকে গ্যাস না থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কমপ্রেসারের মূল লাইনে গ্যাসের চাপ না থাকায় শুধু শিল্পেই নয়, বিভিন্ন বাসাবাড়িতেও গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে। তবে গ্যাস সচল রাখার চেষ্টা চলছে। আশা করা হচ্ছে, অল্প দিনের মধ্যে গ্যাস-সংকট থাকবে না।




তিতাস গ্যাস টান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের গাজীপুর শাখার ব্যবস্থাপক (অপারেশন) রেদুয়ানুজ্জামান টিনিউজকে জানান, জামালপুরের সরিষাবাড়ির তারাকান্দি যমুনা সার কারখানা, এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল, মির্জাপুরের বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত আমরা গ্যাস পাই ৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট। তার মধ্যে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অন্তত ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট যমুনা সার কারখানায় দিতে হচ্ছে। এছাড়াও টাঙ্গাইলের আবাসিক, সিএনজি স্টেশন ও শিল্পকারখানায় মাত্র ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। অন্তত ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলে চাহিদা পুরণ করা সম্ভব হতো।