টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগে বেড়েই চলছে এমপি ও দলীয় নেতাদের দ্বন্দ্ব
স্টাফ রিপোর্টার ॥
টাঙ্গাইলে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে দলীয় নেতাদের দ্বন্দ্ব বেড়েই চলছে। জেলার আটটি আসনের সংসদ সদস্যদের মধ্যে সাতজনের সঙ্গেই তাঁদের নিজ এলাকার নেতাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। কয়েকটি জায়গায় সংসদ সদস্যের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি মিছিল সমাবেশও হয়েছে। সংসদ সদস্যরা নেতাদের মূল্যায়ন না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলীয় নেতারা। তবে একাধিক সংসদ সদস্য টিনিউজকে জানিয়েছেন, স্থানীয় নেতাদের অনেকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। তাই তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারে নেমেছেন। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
দলীয় সূত্র টিনিউজকে জানায়, শুধু টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর নিজ আসনের দুই উপজেলার নেতাদের প্রকাশ্য বিরোধ এখনো দেখা যায়নি। তবে স্থানীয় অনেক নেতার মধ্যেই ভেতরে– ভেতরে চাপা ক্ষোভ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই দুই উপজেলার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা।
টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির সঙ্গে গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ও পৌরসভার মেয়র রকিবুল হক এবং ভূঞাপুর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মেয়র মাসুদুল হকের বিরোধ রয়েছে। এ আসন থেকে আগামী সংসদ সদস্য নির্বাচনে ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু ও মাসুদুল হক মাসুদ দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। তবে ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তাহেরুল ইসলাম সংসদ সদস্যের পক্ষে আছেন। এ বিষয়ে গোপালপুর পৌরসভার মেয়র রকিবুল ইসলাম জানান, সংসদ সদস্যদের খামখেয়ালিপনার কারণেই মাঠপর্যায়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। ভূঞাপুর পৌরসভার মেয়র মাসুদুল হক মাসুদ জানান, সংসদ সদস্য দলকে, দলের নেতাদের ভুলে গেছেন। এজন্যই তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনি জানান, সামনে সংসদ নির্বাচন, যাঁরা প্রার্থী হতে চাইছেন, তাঁরা দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছেন। এটা দলের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খানের সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের মূলধারার নেতাদের মুখ –দেখাদেখি বন্ধ। দলের সভাপতি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিমের নেতৃত্বে চলছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। এদিকে সংসদ সদস্যের ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানার নেতৃত্বে চলছেন সংসদ সদস্যের অনুসারীরা। সংসদ সদস্যের কর্মসূচিতে অংশ নেয় না উপজেলা আওয়ামী লীগ। আর দলীয় কর্মসূচিতে সংসদ সদস্যের অনুসারীরা থাকেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হেকমত শিকদার বলেন, আতাউর রহমান সংসদ সদস্য হলেও তাঁর কাজকর্ম করেন আমানুর রহমান খান রানা। আমানুর রহমান খান রানা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার আসামি। তিনি জামিনে আছেন। তাঁরা দলীয় নেতাদের সঙ্গে সব সময় বিরোধ করেন।
সংসদ সদস্যের অনুসারী ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও আনেহলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তালুকদার মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতারা সংসদ সদস্য এবং তাঁর অনুসারীদের এড়িয়ে চলেন। তাই বাধ্য হয়ে আমরা সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে আমাদের মতো করে রাজনীতি ও উন্নয়নকাজ করে যাচ্ছি।
টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের সংসদ সদস্য হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মোল্লার। মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু বিগত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন পান। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, সংসদ সদস্য সোহেল হাজারীর কারণেই মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু পরাজিত হন। তারপর থেকেই দ্বন্দ্ব আরও বেড়েছে। কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু জানান, সংসদ সদস্য সোহেল হাজারী তাঁর পকেটের লোকদের নিয়ে চলেন। অন্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। এ কারণে তাঁর সঙ্গে নেতাকর্মীদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
এসব বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারী জানান, কারও সঙ্গে আমার কোন বিরোধ নেই।
টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেনের সঙ্গে উপজেলা ও শহর আওয়ামী লীগের নেতাদের সমন্বয় রয়েছে। তবে জেলা কমিটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বেড়েছে। স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন বিএনপি থেকে আসা নেতাদের গুরুত্ব দেন। পুরোনো নেতাদের এড়িয়ে চলেন। এজন্য এ আসনে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন বলেন, তাঁর সঙ্গে জেলার শীর্ষ নেতাদের কোন বিরোধ নেই। তাঁরা তাঁকে সব সময়ই পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন। বিএনপি থেকে আসা নেতাদের গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টিও সঠিক নয়।
টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটুর সঙ্গে নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। দুই উপজেলার নেতাদের অভিযোগ, সংসদ সদস্য দলীয় নেতাদের গুরুত্ব দেন না। দেলদুয়ার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম শিবলী সাদিক বলেন, সঠিক কথা বলা যাবে না, এমপি যা বলবেন তা–ই ঠিক। তিনি (সংসদ সদস্য) এমন নেতা চান। তাই তাঁর সঙ্গে দলীয় নেতাদের দূরত্ব বেড়েছে।
টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনের সংসদ সদস্য একাব্বর হোসেনের মৃত্যু হয় বিগত ২০২১ সালের (১৬ নভেম্বর)। পরে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হন খান আহমেদ শুভ। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খানের ছেলে। গত বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে একাব্বর হোসেনের ছেলে তাহরীম হোসেন সীমান্ত এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি মীর শরিফ মাহমুদ মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা পাননি। তবে গত বছরের (৩১ মার্চ) অনুষ্ঠিত উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শরীফ মাহমুদ সভাপতি ও তাহরীম হোসেন সীমান্ত সাধারণ সম্পাদক হন। সম্মেলনের দিন সংসদ সদস্যের অনুসারীদের উপর শরীফের অনুসারীরা হামলা চালান। বিভিন্ন কারণে এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগ তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে রয়েছেন খান আহমেদ শুভ। অপর দুই গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শরীফ মাহমুদ ও তাহরীম হোসেন সীমান্ত।
মির্জাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাহরীম হোসেন সীমান্ত জানান, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর লোকজন নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেন। এ বলয় ভেঙে ত্যাগী নেতারা সংসদ সদস্য শুভর কাছে যেতে পারেন না। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জিং। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ও হতাশা দূর করতে হবে।
টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের। সখীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ অনেক নেতাই তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সম্প্রতি সখীপুরে এক সমাবেশ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তৃতা করেন। এই সমাবেশে জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহেরের ‘মুক্তিযোদ্ধা হওয়া’ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। বাসাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বেশির ভাগ নেতা–কর্মী সংসদ সদস্যের পক্ষে থাকলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী অলিদ ইসলামের সঙ্গে তাঁর বিরোধ রয়েছে।
সখীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত শিকদার বলেন, সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের ত্যাগী নেতাকর্মীদের ভুলে গেছেন। সব ক্ষেত্রে পরিবার ও আত্মীয়করণ করেছেন।
স্থানীয় সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের বলেন, এটি আদর্শিক কোনো দ্বন্দ্ব নয়, আওয়ামী লীগের সব নেতাই এক এবং অভিন্ন। ভবিষ্যতে দ্বন্দ্ব থাকবে না। সময় এলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবেন।
এসব বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক বলেন, একটি সংসার যখন বড় হয়, তখন সংসারে কিছু সমস্যাও দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ একটি বড় সংসার। তাই কোনো কোনো আসনে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে দলীয় নেতাদেরও দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। তবে সময়মতো সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবেন।