টাঙ্গাইল জেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ১ ডিসেম্বর
রঞ্জিত রাজ ॥
নদী-চর, খাল-বিল, গজারির বন, টাঙ্গাইলের শাড়ি তার গর্বের ধন। শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) টাঙ্গাইল জেলা প্রতিষ্ঠার ৪৮তম বছর। টাঙ্গাইলের সচেতন মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে বিগত ১৯৬৯ সালের (১ ডিসেম্বর) টাঙ্গাইল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ১৯তম জেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এই দিনে গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এম আহসান হাজার হাজার উৎফুল্ল মানুষের উপস্থিতিতে টাঙ্গাইল জেলার উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন।
কিন্তু এই গৌরবমন্ডিত দিনটি ৪৮ বছর ধরে নজর এড়িয়ে নীরবে আসে, নীরবে চলে যায়। অথচ এ দেশের চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অতি জাঁকজমকের সাথে ঘনঘন পালিত হয়ে আসছে। ইতোপূর্বে টাঙ্গাইলের কতিপয় সংস্কৃতিবান মানুষ জেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ নিলেও নানা কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। তাই তাদের দাবি, অতীতের ভুলভ্রান্তি ভুলে আগামী বছর থেকে যেন টাঙ্গাইল জেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবার সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
টাঙ্গাইল জেলা আজকের এই দিনে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই টাঙ্গাইলের মানুষ নিজেদের দেশের প্রতিটা ক্ষেত্রে দেশব্যাপী পরিচিতি তুলে ধরার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা তারই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রাকৃতিক বৈচিত্র টাঙ্গাইলকে এক বিশেষ ঐশ্বর্য দান করেছে। উত্তর ও পূর্বে প্রাচীন লালমাটির উঁচু ভূমির ধ্যানমগ্ন পাহাড়। তার মধ্যে নানা উপজাতি লোকের বিচিত্র জীবনযাপন, গজারী, সেগুন, গামার, কড়ি, মেহগনি বৃক্ষরাজির সারি অনন্তকাল যাবত নামাজের জামায়াতে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে সমতল ভূমি, তার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ছোট ছোট আঁকা বাঁকা নদী। পশ্চিমদিকে দুরন্ত যৌবনা বিশাল যমুনা নদী। নদীর মধ্যে মধ্যে অসংখ্য নতুন নতুন চর। চর তো নয় যেনো দুধের সর। সেখানে কূলে কূলে শিশুদের খেলা ঘরের মতো নিত্য নতুন নতুন ঘরবাড়ি নতুন জীবন। এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে বিজয়ী মানুষের উড্ডীন রাঙা পতাকা।
টাঙ্গাইলের চমচমের নাম শুনলে কার না জিভে পানি আসে! আর টাঙ্গাইল শাড়ি কোন নারীর মন না ভুলায়? শুধু চমচম আর শাড়িই নয়, বাংলা কাব্য সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির অঙ্গনে টাঙ্গাইলের গর্ব করার মতো অনেক অসংখ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন। যাদের নিরলস শ্রম, ত্যাগ সাধনা ও সংগ্রামে জাতি ধাপে ধাপে উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে। ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে তাদের নাম। জাতি তাদের কখনো ভুলবে না।
টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন-
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (২৯ ডিসেম্বর, ১৮৬৩-১৭ এপ্রিল, ১৯২৯)- প্রতিষ্ঠাতা ধনবাড়ীর নবাব বাড়ী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১২ ডিসেম্বর, ১৮৮০-১৭ নভেম্বর ১৯৭৬) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি- আওয়ামী লীগ। শামসুল হক (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৮-১৯৬৫) রাজনীতিবিদ। প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক- আওয়ামী লীগ। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা (নভেম্বর ১৫, ১৮৯৬-১৯৭১, ৭ মে,)- দেশের বিখ্যাত সমাজসেবক এবং দানবীর। প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ (১৮৯৪-২৯ মার্চ, ১৯৭৮)- শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী, রাজনীতিবিদ ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক।
আবু সাঈদ চৌধুরী (জানুয়ারি ৩১, ১৯২১-আগস্ট ১, ১৯৮৭) বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী (জন্ম-১৯৪৭) ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাঘা সিদ্দিকী নামে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী গড়ে ওঠে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক। মামুনুর রশীদ (২৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮) দেশের একজন প্রখ্যাত নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের মঞ্চ আন্দোলনের পথিকৃত। মান্না (১৯৬৪-ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০০৮) দেশের একজন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক ছিলেন।
দর্শনীয় স্থানগুলো হলো- ফালুচাঁদ চীশতি-এর মাজার, আতিয়া মসজিদ, মধুপুর জাতীয় উদ্যান, বঙ্গবন্ধু সেতু, আদম কাশ্মিরী-এর মাজার, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মাজার, পরীর দালান/হেমনগর জমিদার বাড়ি, খামারপাড়া মসজিদ ও মাজার, ঝরোকা, সাগরদীঘি, গুপ্ত বৃন্ধাবন, পাকুটিয়া আশ্রম, ভারতেশ্বরী হোমস, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ, পাকুল্লা মসজিদ, আরুহা-শালিনা পাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, নাগরপুর চৌধুরী বাড়ী, পুন্ডরীকাক্ষ হাসপাতাল, উপেন্দ্র সরোবর, গয়েহাটার মঠ, তেবাড়ীয়া জামে মসজিদ, এলেঙ্গা রিসোর্ট, যমুনা রিসোর্ট, কাদিম হামজানি মসজিদ, ঐতিহ্যবাহী পোড়াবাড়ী, করটিয়া সা’দত কলেজ, কুমুদিনী সরকারি কলেজ, বিন্দুবাসিনী বিদ্যালয়, দোখলা ভিআইপি রেস্টহাউস, পীরগাছা রাবার বাগান, ভূঞাপুরের নীলকূূূূঠি, শিয়ালকোল বন্দর, ধনবাড়ী মসজিদ ও ধনবাড়ি নবাব প্যালেস, নর্থখোলা স্মৃতিসৌধ, বাসুলিয়া, রায়বাড়ী, কোকিলা পাবর স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, ধলাপাড়া চৌধুরীবাড়ী, মহেরা জমিদার বাড়ী, রাধা কালাচাঁদ মন্দির, পাকুটিয়া জমিদার বাড়ী, বনগ্রাম গনকবর, স্বপ্ন বিলাস (চিড়িয়াখানা), মোকনা জমিদার বাড়ী, তিনশত বিঘা চর, বায়তুল নূর জামে মসজিদ, দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি, নাগরপুর জমিদার বাড়ি, এলাসিন ব্রিজ, ডিসি লেক, এসপি পার্ক, সোল পার্ক, ২০১ গম্বুজ মসজিদ, চারান বিল।
ময়মনসিংহ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিপক্ষে যৌক্তিকতা প্রমাণে টাঙ্গাইলের মানুষ ইস্পাতদৃঢ় মনোভাবের পরিচয় রেখেছেন। যার নেতৃত্বে এ দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে তিনি টাঙ্গাইলের প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের প্রশাসক ফজলুর রহমান খান ফারুক।
উল্লেখ্য, ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত টাঙ্গাইল মহুকুমাকে ১৯৬৯ সালের (১ ডিসেম্বর) টাঙ্গাইলকে বাংলাদেশের ১৯তম জেলা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এ জেলার উপজেলা সংখ্যা ১২টি, আয়তন- এক হাজার তিনশ’ নয় বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৮শ’ ৫৭ জন।