টাঙ্গাইলে নববর্ষে হালখাতার লাল সালু টালি এখন শুধুই স্মৃতি
স্টাফ রিপোর্টার ॥
দূর অতীত- লম্বা সাদা কাগজ বাঁধাই করে লাল সালু কাপড়ে মুড়িয়ে দুই ভাঁজ করে মোটা লাল সাদা প্যাঁচানো সুতায় রাখা একটি খাতা। হিসাবের এই খাতার প্রতি পাতায় চারটি করে সমান ভাঁজ। বাম ধারে জমা। ডান ধারে খরচ। কেউ বলত টালিখাতা। পাতার শুরুতেই কোনো ব্যক্তির নাম-ঠিকানা। চেনার প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত ঠিকুজি। নববর্ষের প্রথমদিনে হিসাবের এই খাতা উদ্বোধন করা হয় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে। সামিয়ানা টাঙিয়ে মাইকে গান বাজিয়ে মিষ্টি মুখ করিয়ে। খাওয়ার মধ্যে লুচি, বুন্দিয়া, সবজি থাকবেই। যে যতটা পারে খাবে। খাদ্য তালিকায় পোলাও ছিল। ঘরের ভেতরে বিশেষ ধরনের কাঠের ক্যাশ বক্সের পেছনে বসে থাকেন দোকানি (মহাজন)। ভোজন শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে অতিথিরা মহাজনের কাছে গিয়ে হাত মিলিয়ে গেল বছরের পাওনার পুরো অর্থ অথবা পরিশোধে সেই খাতায় নতুন করে নাম লেখান। হিসাব হালনাগাদকরণের এই খাতার নাম ‘হালখাতা’।
বাঙালীর জীবনে হালখাতার এই উৎসব নিয়ে আসে বাংলা নববর্ষ। দিনা কয়েক পরই পহেলা বৈশাখ। যারা ওই মহাজনের দোকানে সওদাপাতি করেন (ক্রেতা) চৈত্র মাসের শেষদিকে তাদের কাছে হালখাতার নিমন্ত্রণপত্র যায়। সেখানে আলাদা কাগজে পাওনার হিসাব থাকে। নিমন্ত্রণপত্র পাওয়ার পর সেই ব্যক্তি পাওনা পরিশোধের সঙ্গে ভালোমন্দ ভোজনেরও প্রস্তুতি নেয়। নির্দিষ্ট দিনে পরিষ্কার পোশাক পরে আতর-সুগন্ধী মেখে হাজির হন মহাজনের বাড়িতে। যেখানে হালখাতার উৎসবের সঙ্গে শুরু হয় সামাজিক বন্ধনের এক মিলন মেলা। হালখাতার ইতিহাস থেকে জানা যায়- মুঘলরা হিজরি সন ধরে তাদের অধিনস্ত রাজ্য থেকে খাজনা আদায় করত। বঙ্গদেশের প্রজারা অনেক সময় সময়মতো খাজনা পরিশোধ করতে পারত না। প্রধান কারণ ছিল, কৃষি ফসল হিজরি সনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরে উঠত না। অসন্তোষ ছিল কৃষকের মধ্যে। তা দূর করতেই সম্রাট আকবর নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরির নির্দেশ দেন। তৎকালীন বাংলার খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজী সৌরসন, চন্দ্র ও হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। কার্যকর হয় ১৫৫৬ খ্র্টিাব্দে। নতুন সনের নাম ছিল ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দের নববর্ষ নামে পরিচিতি পায়। তখন প্রজারা চৈত্র মাসের মধ্যে খাজনা পরিশোধে বাধ্য ছিল। পরের দিন জমির মালিকরা নিজ নিজ এলাকায় লোকজনের মধ্যে মিষ্টি মুখ করাত। এ উপলক্ষে নানা উৎসবের আয়োজন হতো। পহেলা বৈশাখের বড় কাজ ছিল হিসাবের খাতা হালনাগাদ করা। সংক্ষেপে হালখাতা। হিসাবের নতুন বই। পরবর্তী সময়ে হালখাতা ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই দিন ঘরদোর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধুয়ে-মুছে ঝকঝকে করা হয়। ক্রেতারা পাওনা পরিশোধ করতে এলে প্রথমেই মিষ্টিমুখ করানো হয়। পহেলা বৈশাখের সঙ্গে সমান্তরাল ধারায় চলতে থাকে হালখাতা।
সেদিনের হালখাতা নিকট অতীতে বিচ্ছিন্নভাবে টিকে ছিল। হালখাতা যতটা না খাওয়াদাওয়া তার চেয়ে বেশি ছিল সমাজের মেলবন্ধন। হালখাতা আয়োজনে ছেলেমেয়ে সঙ্গে নিত অনেকেই। এতে মহাজন বেজার না হয়ে খুশিই হতেন। বলতেন অতিথির যে ঘরে প্রবেশ সেই ঘর ভাগ্যবান। হালখাতার আয়োজনে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিষ্ঠান ধুয়ে-মুছে সাফসুতরো করে রাখতেন। রঙিন কাগজ ও সুন্দর কাপড় দিয়ে সাজানো হতো। নববর্ষের উৎসবের সঙ্গে হালখাতা নতুন মাত্রা এনে দিত। বৈশাখ মাস শুরুর সঙ্গেই হালখাতার আয়োজন চলত প্রায় মাসজুড়ে। বছরের অক্ষয় তৃতীয়াতে হালখাতা হতো বেশি।
বর্তমানে সেদিনের লাল সালুতে মোড়ানো সেই হালখাতা আর নেই। খাতা আছে, তবে তা লাল রঙে বাঁধাই করা লম্বাচওড়া খাতা। বড় ব্যবসায়ীরা হিসাব লিখে রাখে কম্পিউটারে আলাদা ফাইলে। কি বোর্ডে চাপ দিলেই সকল হিসাব বের হয়ে আসে। একেবারে নখ দর্পণে ডেবিট- ক্রেডিট হিসাব। একটা সময় বেচাকেনায় ব্যবহার হতো ক্যাশমেমো। ডিজিটাল যুগে প্রিন্ট আউট বের হয়ে আসে। কম্পিউটার রশিদে কোনো সিল-স্বাক্ষর লাগে না। বর্তমানে নগর জীবনে বাকির কারবার প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। নগদ টাকা, চেক, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ডে মানি ট্রান্সফার, পয়েন্ট অব সেলে (পিওএস বা পস) ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডে পরিশোধ ইত্যাদি। ব্যাংকের ভিসা কার্ডে অনলাইনেও কেনাকাটা হচ্ছে। কিছু দোকানে যে বাকির চল আছে তাও খাতা কাগজে। গ্রামের হাটবাজারে বাকি বেচাকেনা খাতায় টুকে রাখা হয। যে কারণে সেদিনের সেই সামাজিক মিলন মেলার লুচি-বুন্দিয়া-সবজি খাওয়ার হালখাতা দিনে দিনে দূর অতীতের স্মৃতিময় অধ্যায় হয়ে গেছে। বর্তমান প্রজন্ম ‘হালখাতা’ শব্দটির সঙ্গেও পরিচিত নয়। তবে মাঝেমধ্যে কোনো ব্যাংক ঋণ আদায়ে হালখাতা শব্দটি ব্যবহার করছে।
টাঙ্গাইল জেলায় হালখাতার সেই দিনগুলি আজ অতীত। শুধু নামটি ঐতিহ্যের সঙ্গে টিকে আছে। তালুকদার মার্কেটের খাতা ব্যবসায়ী ও বাইন্ডার সেলিম শেখ টিনিউজকে বলেন, বছরকুড়ি আগেও চৈত্র মাস পড়লে লাল কভারের টালিখাতা তৈরি ও বিক্রি হতো। এখন আর কেউ এ ধরনের খাতা চায় না। কোনো কোনো মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর ঘরে এই খাতা আছে। তারা বানিয়ে নেয়। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরাও দোকানে পস মেশিনে মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা রেখেছে। অনেকেই বাকির খাতার বদলে ব্যবহার করছে কম্পিউটার। অন্যতম ব্যবসায়ী আশিষ কুমার সাহা টিনিউজকে বলেন, পূর্বপুরুষদের হালখাতা দেখেছেন। তিনি হালখাতার বদলে ডিজিটাল প্রযুক্তির যন্ত্রে হিসাব-নিকাশ করেন। বৈশাখের সামাজিক মেলবন্ধনের হালখাতার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তবুও হালখাতা আসে। লাল সালু কাপড়ে মোড়ানো কোনো খাতায় নয়। লাল রঙে বাইন্ডিং করা বড় খাতায়। আছে ক্যালকুলেটর। বড় ব্যবসায়ীদের হিসাব আছে এলইডি স্ক্রিনের আধুনিক কম্পিউটার যন্ত্রে। যেখানে জমা খরচে (ডেবিট-ক্রেডিট) হাতের লেখা ও আঙুলের রেখায় গুনতে হয় না। নামতা পাঠ করে সংখ্যা বসাতে হয় না। হালখাতা এখন ডিজিটাল খাতা। জীব ঠিকই আছে, শুধু জড় পদার্থের পরিবর্তন।