টাঙ্গাইলের চারাবাড়ীতে ধলেশ্বরী নদীতে মাটিখেকোরা বেপরোয়া ॥ হুমকির মুখে সেতু

0 196

স্টাফ রিপোর্টার ॥
নদীমাতৃক বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলাকে এক করেছে ধলেশ্বরী নদী। মূলত দেশের মধ্যভাগে দিয়ে প্রবাহিত এই জলধারা কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে শিল্প-সাহিত্যের ঐতিহ্যময় নগরী টাঙ্গাইল। এই নদীর কাগমারী তোরাগঞ্জ ধলেশ্বরী ব্রিজটি ভূমিখেকোদের দখলে। ব্রিজের দুই পাশের মাটি কেটে এমন অবস্থা তৈরি করেছে ভূমিদস্যুরা যে, যে কোনো সময় তিন লাখ লোকের যাতায়াতের অন্যতম এই মাধ্যমটি ভেঙে পড়ে যেতে পারে। বাদ যায়নি পার্শ্ববর্তী সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সংসদ (এসডিএস) প্রকল্পও। এই প্রকল্পের প্রায় ৫০০ বিঘা জমির পুরোটাতেই গর্ত। মাটি কেটে পুরো এলাকায় বছরের পর পর দৌরাত্ম্য চালাচ্ছে এই দুর্বৃত্তরা। এ নিয়ে মঙ্গলবার (২ মে) দুই মাটিখেকো গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এতে তিনজন আহত হয়েছে এবং এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।




সরেজমিনে দেখা যায়, ধলেশ্বরী নদীর তোরাগঞ্জ সংলগ্ন তিন ইউনিয়ন দাইন্যা, পোড়াবাড়ী ও কাতুলী ইউনিয়নের বাসিন্দাদের চলাচলের একমাত্র ভরসা ধলেশ্বরী ব্রিজের দুই পারের মাটি এমনভাবে কেটে নেওয়া হয়েছে যে, যে কোনো সময় ব্রিজের সংযোগস্থল ভেঙে পড়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রায় ৫০০ বিঘা জমির ওপর এসডিএস প্রকল্পের খামারের প্রায় পুরোটাই স্থানে স্থানে গর্ত করা। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, টাঙ্গাইল সদরের ১১নং কাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান সুমন আহমেদের নেতৃত্বে প্রায় প্রতিদিনই রাতের আঁধারে চলে মাটি উত্তোলনের কাজ। অপরদিকে একই স্থানে মাটি উত্তোলনে আধিপত্য বিস্তারে আস্তানা গেড়েছেন টাঙ্গাইল জেলা শ্রমিক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আব্বাস আলীর নেতৃত্বে সন্ত্রাসী গ্রুপ। তাদের মদতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এলাকার ১২ জনের একটি চক্র। স্থানীয় বাসিন্দাদের মানববন্ধন, জমির মালিকদের প্রতিরোধ এবং প্রশাসনের কাছে দফায় দফায় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সবকিছুই ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে অদৃশ্য ইশারায়। এর প্রভাবে আরও আগ্রাসী এখন দেওয়ান সুমন ও তার মদতপুষ্ট মিজান এবং অপর গ্রুপের আব্বাস আলীসহ মাটিখেকো চক্রের সদস্যরা।




এলাকাবাসী জানান, প্রায় দুই যুগ ধরে চলছে কাগমারী তোরাগঞ্জ সংলগ্ন এসডিএসের নিজস্ব জমিতে এই ধ্বংসযজ্ঞ। পুলিশ ও প্রশাসন যারাই এই জেলায় দায়িত্বে আসেন, শুরুতেই তাদের ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেন সুচতুর সুমন ও আব্বাস বাহিনী। জানা যায়, ধলেশ্বরী ব্রিজসংলগ্ন সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সংসদের (এসডিএস) প্রকল্পটি থেকেই মূলত মাটি কাটা শুরু হয়। আনুমানিক ১৫২ একর (৫০০ বিঘা) জমির ওপর ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে সবুজ বন। সঙ্গে মৎস্য চাষ থেকে শুরু করে গরু, হাঁস-মুরগি পালন কার্যক্রম। পুরো প্রকল্প এলাকার মাটি কাটতে কাটতে এক পর্যায়ে তা ধলেশ্বরী ব্রিজের দুই পারেও শুরু হয়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, দেওয়ান সুমন ও আব্বাস আলী এই দুই গ্রুপ প্রথমেই প্রায় পাঁচ লাখ গাছ ধ্বংস করে পুরো প্রকল্পের জায়গাকে বিরানভূমিতে পরিণত করে ফেলেন। এরপর মাটি বিক্রি করা শুরু করেন। গত দশ বছর ধরে জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ায় সুন্দর সমতল ভূমিতে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত। আবার জমি ঘেঁষে বহমান ধলেশ্বরী নদীর চিহ্ন খুঁজে পাওয়ার জো নেই। স্থানীয়দের অভিযোগ, সমতল ভূমিতে প্রতিনিয়ত চলছে ভেকু দিয়ে মাটি উত্তোলন এবং চক্রটি তা বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সূর্যাস্তের পর সচল হয় ছয়টি ভেকু। আর দিনের আলো ফোটার আগেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয় যন্ত্রগুলো। দীর্ঘ সারিতে দাঁড়ায় মাটিবাহী ট্রাক। মাটি ভরে নিয়ে চলে যায় ক্রেতার ঠিকানায়।




বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এর ধারা ৪ এর (খ) অনুযায়ী, সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক ও মহাসড়ক, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। এসব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জোরপূর্বক চলছে মাটি উত্তোলন ও সমতল ভূমি ধ্বংস। প্রায় দশ বছর ধরে মাটি জোরপূর্বক কেটে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিরা জড়িত। তাদেরই মদতপুষ্ট হয়ে মাটি কাটছেই, বাদ দেয়নি ধলেশ্বরী ব্রিজ এলাকাও। ব্রিজের দুই পাশের মাটিও কেটে নিয়ে বিক্রি করে। স্থানীয় জনগন যখন মাটি কাটা বন্ধ করতে চায়, তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। ওই এলাকায় প্রায় পাঁচ লাখ বনজ গাছ ছিল ও দুই লাখের ওপরে ফলদ গাছ ছিল; সেগুলোও ক্ষমতা দেখিয়ে কেটে নিয়ে গেছে, এই মাটিখেকোরা। ডিসি ও পুলিশ প্রশাসন বরাবর অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিকার পাওয়া যায় না।




তবে নিজের ওপর আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাটিখেকো দেওয়ান সুমন আহমেদ। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে ডিসির কাছে অভিযোগ দিয়েছে এটা সত্য। আবার মানববন্ধন হচ্ছে তা-ও সত্য। যেখান থেকে মাটি কাটার অভিযোগ করা হচ্ছে, সেখানে আমার নিজের, আমার পিতা, দাদা ও আত্মীয়স্বজনের জমি আছে। যারা অভিযোগকারী তাদের এক ছটাক জমিও সেখানে নেই। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সব মিথ্যা। তবে ভুক্তভোগী ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতার মদতে বিএনপি সমর্থিত সাবেক এই চেয়ারম্যান এতো বেপরোয়া। অপর মাটিখেকো টাঙ্গাইল জেলা শ্রমিক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আব্বাস আলী বলেন, এসডিএস ২০০২ সাল থেকে বিলুপ্ত। এই প্রকল্প থেকে প্রতিবছর ৫ থেকে ৮ কোটি টাকার মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। এর প্রতিবাদে আমরা আন্দোলন করছি।




এসব অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন টাঙ্গাইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু সালাম মিয়া। তিনি বলেন, আমাদের কাছে প্রায় সময়ই ধলেশ্বরী ব্রিজের আশপাশ এবং এসডিএস প্রকল্প থেকে মাটি কাটার অভিযোগ আসে। আমরা সরেজমিনেও তার প্রমাণ পেয়েছি এবং নানা সময় অভিযানও পরিচালনা করেছি। তবে আমাদের একার পক্ষে সব দেখা সম্ভব নয়। এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড রয়েছে, জেলা প্রশাসন রয়েছে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এটি রোধ করা সম্ভব।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

ব্রেকিং নিউজঃ