ঘাটাইলে কেমিক্যাল বালাইনাশক ছাড়াই ফল উৎপাদনের স্বপ্ন শিক্ষক শামসুলের

175

আব্দুল লতিফ, ঘাটাইল ॥
শিক্ষাই জাতীর মেরুদন্ড। আর একজন শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকতার পাশাপাশি অনেকেই নানা প্রকার পেশার সাথে নিজেকে জড়িয়েছে। কেউ শখের বসে কেউ বানিজ্যিকভাবে। ঠিক তেমনি একজন মানুষ গড়ার কারিগর হলেন টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের শিক্ষক শামসুল আলম। কর্মরত আছেন ঘাটাইল এস.ই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃষি বিষয়ক শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রকৃতিপ্রেমী এই শিক্ষক সাড়ে সাত একর জমিতে দেশি-বিদেশী প্রজাতি মিলে লাগিয়েছেন ১১৯ ধরনের ফলদ গাছ। স্কুল সময় বাদে গড়ে তোলা তাঁর এ ফলের বাগান দেখতে নিজ জেলাসহ ভিড় করছেন অন্যান্য জেলার মানুষও। অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই গড়ে তুলেছেন বাগান। কোনো গাছে শোভা পাচ্ছে ফুল আবার কোনো গাছে থোকায় থোকায় ধরে আছে দেশী বিদেশী পরিপক্ক ফল ও ফলের গুটি। ফল জাতীয় খাদ্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানোর এ যুগে তিনি স্বপ্ন দেখেন নিরাপদ ফল উৎপাদনে। স্বপ্নকে তিনি রূপ দিয়েছেন বাস্তবে। যে কারও চোখ জুড়াবে এ দৃশ্য দেখে। ফুল থেকে শুরু করে ফল পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয় না কোনো প্রকার ক্ষতিকর কেমিক্যাল। যেখানে পোকা দমনে জৈব বালাই নাশকই যথেষ্ট।




শিক্ষক শামসুল আলম টিনিউজকে জানান, কৃষি বিষয়ে শিক্ষক হওয়ায় কৃষি কাজের প্রতি তাঁর টান ছিল আগে থেকেই। শুরুটা শখের বসে হলেও এখন তা রূপ নিয়েছে পরিকল্পিত ও বাণিজ্যিক পর্যায়। বাগানে মোট জমির পরিমাণ সাড়ে সাত একর। তাঁর এ বাগান করার উদ্দেশ্য অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন। ফলে থাকবে না কোনো কেমিক্যাল। গাছে প্রয়োগ করা হবে না কোনো প্রকার ক্ষতিকর মেডিসিন। পোকা দমনে জৈব বালাই নাশকই হবে যথেষ্ট। ফল গাছ কেনা থেকে শুরু করে বেড়া দেওয়া সেচযন্ত্র ক্রয়সহ এ পর্যন্ত মোট স্থায়ী খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। ১১৯ জাতের ফল গাছে জৈবিক সারসহ পরিচর্চা বাবদ বছরে খরচ হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। সব খরচ বাদে এ বছর বিভিন্ন জাতের ফল বিক্রি করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা লাভ হবে বলে জানান শামসুল আলম। এরই মধ্যে কমলা ৬০ হাজার টাকা, মাল্টা ৫০ হাজার, আম ৩৫ হাজার এবং লটকন বিক্রি করেছেন দুই লাখ টাকা। বাজারে নাকি এ ধরনের ফলের চাহিদাও রয়েছে অনেক। এ বছর লটকনের বাম্পার ফলন হয়েছে। তাঁর বাগানে লটকনের গাছ রয়েছে আড়াই হাজার। শতকরা ৮০ ভাগ গাছে লটকনের ফলন হয়েছে।
শামসুল আলম টিনিউজকে আরও বলেন, লটকনের ফলন আসে প্রায় পাঁচ বছর পর। লটকন গাছে ফল না আসায় স্থানীয় লোকজন একটা সময় বলাবলি শুরু করেন; মাস্টার কি কাজ শুরু করলেন, বড় ধরনের ধরা খাবেন মাস্টার। আর আজ সেই মানুষগুলোই লটকন গাছের বাগান করতে তাঁর কাছে চারার অর্ডার করছেন। সারা বছরই তাঁর বাগানে পাওয়া যায় দেশী বিদেশী মিলে ৩০-৩৫ ধরনের ফল। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে ১২ জন নারী-পুরুষ শ্রমিকের। বিদেশী ফল চাষের বিষয়ে শামসুল আলম টিনিউজকে বলেন, মূলত ভিন দেশী ফল চাষ করে আমাদের দেশে তার অভাব পূরণ করা। আর বিভিন্ন ধরনের কলমের মাধ্যমে এসব গাছ গুলোর বংশবিস্তার ঘটিয়ে অন্যান্য চাষিদের মাঝে তা ছড়িয়ে দেওয়া।




বিদেশী ফল গাছগুলো হলো- সৌদি খেজুর- ভিয়েতনামী ওপি নারিকেল, ড্রাগন ফল, ত্বীনফল, কালো আংগুর, আপেল, রামবুটান, নাশপাতি, এগফ্রুট (সাউথ আফ্রিকা), ডুরিয়ান (মালয়েশিয়ার জাতীয় ফল), অ্যাভোকাডো, ম্যাংগোস্টিন, কফি, মিরাক্কেল, থাই বাতাবী লেবু, চায়না কমলা, চায়না লিচু, চায়না পেয়ারা, থাই পেয়ারা, লকেট, সুদানী শরিফা, জাপটিকাবা, আলু বোখারা, প¬ামফল, পামওয়েল, বিলেতি গাব, অ্যানোনিয়া, সাতকরা, ব্রনাই, কিং আম , ব্যানানা ম্যাংগো, কিউজাই আম (থাইল্যান্ড), অ্যামেরিকান সুন্দরী আম ইত্যাদি। দেশীয় ফল গাছগুলো হলো -আম, মাল্টা, কমলা, জাম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, আনারস, আমলকি, জামরুল, শরিফা, আরবরই, ছফেদা, পেয়ারা, আতা, ডালিম, চালতা, কামরাঙ্গা, জলপাই, নারিকেল, পিচফল, মালবেরী, লেবু, পেঁপে, চেরীফল, কদবেল, করমচা, কাউফল, হেমফল, বাতাবী লেবু, তেঁতুল, কাঠলিচু, তাল, বেল, আমড়া, বাউকুল, বিলম্বি, কাজুবাদাম, পেস্তাবাদাম, কাঠবাদাম, মোসম্বি, ছাগল নাদা, তিতিজাম, গাব, বাংগি, লুকলুকি ইত্যাদি।
শামসুল আলম শুধু সফল একজন কৃষকই নন, একজন সুশিক্ষকও। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি হাতেকলমে শিক্ষার বাস্তব উপকরণ তার এ বাগান। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গড়ে তোলা বাগানে বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাগান পরিদর্শন করান তিনি। গাছ লাগান থেকে শুরু করে পরিচর্চা কিভাবে করতে হয় তা হাতে কলমে শিক্ষা দেন তিনি। প্রকৃতিপ্রেমী শিক্ষক শামসুল আলম টিনিউজকে বলেন, আমার ইচ্ছে আছে দেশী-বিদেশী উন্নত ফলের চারা উৎপাদন করে স্বল্প মূল্যে চাষীদের মাঝে ছড়িয়ে দেব। এরই মধ্যে বাগান করার পরিকল্পনা নিয়ে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে প্রায় অর্ধেক জেলার লোকজন পরিদর্শন করেছেন তাঁর এ বাগান। নিয়েছেন পরামর্শ। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে বিভিন্ন সময় পরামর্শ এবং কারিগরী সহায়তা পেয়ে থাকেন বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিলশাদ জাহান টিনিউজকে বলেন, শামসুল আলম একজন মিশ্র ফলচাষী। একজন উদ্যোগতা। তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ। নিরাপদ ফল উৎপাদনের লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। প্রতিনিয়ত তাঁর এ কাজে উপজেলা কৃষি অফিস পরামর্শ এবং কারিগরী সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ তিনি শামসুল আলমের বাগান একাধিকবার পরিদর্শন করেছেন বলে জানান।