গোপালপুরে হবি বাহিনী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশের চোখে ফেরারী
স্টাফ রিপোর্টারঃ
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের বেড়াডাকুরি গ্রামের মৃত এখলাছের ছেলে হাবিবুর রহমান হবি। বিগত ’৮৫ সালে জাতীয় পার্টির ক্যাডার হিসাবে অনুপ্রবেশ তার। ’৮৯ পর্যন্ত এক ইউপি চেয়ারম্যানের মদদে জাতীয় পার্টির ক্যাডার ছিলেন। এরপর সন্ত্রাসী হবি বিগত ’৯১সালে সরকার বদল হলে বিএনপিতে যোন দেন। তখন থেকেই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো শুরু। ’৮৬ সালের জানুয়ারীতে ভেঙ্গুলা পূর্বপাড়ার তমছের আলীর পুত্র বিএনপি কর্মী আব্দুল গফুরকে জবাই করে হত্যা করে হবি। লাশ ফেলে রাখে ডাকুরি ও বাগআাচড়া গ্রামের সীমান্তে। গোপালপুর থানায় দায়ের করা এজাহারে, ‘ডাকাতির মালামাল ভাগাভাগির বিরোধকে কেন্দ্র করে এ খুন হয়’ বলে উল্লেখ ছিল।
জাতীয় পার্টির নেতাদের হস্তক্ষেপে সে মামলায় আপোষ হয় বাদী। একই সালের মে মাসে বেড়াডাকুরি গ্রামের হাসু মিয়াকে কুপিয়ে জখম করে হবি। এ মামলায় বেশ ক‘মাস জেল হাজতে ছিল। ভয়ে কেউ সাক্ষি না দেয়ায় অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পায় হবি। পরে পঙ্গু হয়ে হাসু তিন বছর পর মারা যায়। ১৯৮৭ সালের মে মাসে ডাকুরি গ্রামের মৃত সবুর মাস্টারের পুত্র গোপালপুর উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি এনামুল হক এনাকে হত্যা করে হাবিবুর রহমান হবি। ওই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে এক ইউপি চেয়ারম্যান ও জাতীয় পার্টিও নেতার হাত থাকার অভিযোগ ছিল নিহতের পরিবারের। নিহতের এক বড় ভাই যিনি একাত্তরে আলবদর বাহিনী টাঙ্গাইল জেলা শাখার প্রধান ছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর রমনা রেসকোর্স ময়দানে হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পনের সময় পাক বাহিনীর সাথে বন্দী অবস্থায় ভারত এবং পরে পাকিস্তান যান এবং বর্তমানে জাপান প্রবাসি তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের নিকট লিখিতভাবে এ তথ্য দিয়েছিলেন।
জানা যায়, ওই ইউপি চেয়ারম্যান ও তার পরিবার প্রথমে মুসলিম লীগ এবং পরে ’৭৯ সালে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ৮৪ সালে এরশাদের দলে যান। জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি শামসুল হক তালুকদার এবং উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আশরাফুল হক শোভার লবিংয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের হস্তক্ষেপে পুলিশ ওই ইউপি চেয়ারম্যানকে এনামুল হত্যার দায় থেকে কৌশলে অব্যাহতি দেয়। এর মধ্যে ’৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন ঘটলে ওই ইউপি চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি থেকে পুনরায় বিএনপিতে আসেন। ডাকাত হবি তখন এনামুল হত্যা মামলায় জামিনে ছিলেন। গড়ফাদারের পাশাপাশি হবিও জার্সি বদলিয়ে বিএনপিতে আসে। কিন্তু ওই সময়ে এনামুল হত্যা মামলায় হবির যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। গত ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারের সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি পায় সন্ত্রাসী হবি। জেলখানা থেকে বেরিয়ে হবি আবার একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে। সদস্যরা হলো হরিষা গ্রামের সুরুজ মুদী, দড়িশয়া গ্রামের ইয়াকুব ও তোফাজ্জল, বেড়াডাকুরি গ্রামের মামুন, লেবু, কালু, বারেক মুদী, মৌজা ডাকুরি গ্রামের রহিম এবং পাতিলাডুবি গ্রামের খন্দকার রফিকুল। এদের মধ্যে কালু, রহিম ও খন্দকার রফিকের বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা রয়েছে। গত ২৩ অক্টোবর গোপালপুর প্রেসক্লাবে ঝাওয়াইল ইউনিয়নবাসির ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলনে হবি বাহিনীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য রাখেন বেড়াডাকুরি গ্রামের এরশাদুল হক আজাদ ও ইমরুল হাসান। এ সময়ে ওই ইউনিয়নের শতাধিক মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত অভিযোগে বলা হয়, সরকারের সাধারণ ক্ষমায় জেল থেকে বেরিয়ে দুর্ধষ হবি ডাকাত আবার স্বমূর্তিতে আর্বিভূত হয়েছে। সুযোগ পেলেই এলাকায় খুনখারাপি, চুরিডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মোবাইলে হুমকি ধামকি দিয়ে নিরীহ মানুষকে তটস্থ করে তুলছে। প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র উঁচিয়ে মানুষকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। দলনেতা হবির নিকট বিদেশী পিস্তল, সুরুজ মুদীর নিকট কাটা রাইফেল এবং খন্দকার রফিকের নিকট পিস্তল রয়েছে।
লিখিত অভিযোগে আরো বলা হয়, গত ২০১৩ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনের নামে হবি ও তার দলবল ওই ইউনিয়নে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ওরা তিন মাসে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সাধারণ পথচারিদের ৩৫টি মোটর সাইকেল, দু’টি সিএনজি ও তিনটি ইজিবাইক পুড়িয়ে দেয়। ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর একাধিক মামলার আসামী হবি ও তার দলবলকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ অভিযান চালালে ঘোড়ামারা ব্রিজের কাছে হেমনগর ফাঁড়ির পুলিশের উপর হামলা চালানো হয়। রাম দায়ের কোপে দারোগা শরীফ উদ্দীন ভূইয়া এবং কনস্টেবল আব্দুল মজিদ গুরুত্বর জখম হন। পরে পুলিশ বাদী হয়ে হবিসহ তার দলের ২২জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করে। একই সালের ২৬ নভেম্বর মোহাইল গ্রামের কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমান তালুকদার ব্যবসায়িক পাওনা ৭৫ হাজার টাকা নিয়ে মোটর সাইকেল যোগে ভেঙ্গুলা বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঘোড়ামারা ব্রিজের নিকট হবি ও তার দলবল হামলা চালিয়ে টাকা ছিনতাই, মারপিট ও মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়।
ওই সময়ে তারাকান্দি-ভূঞাপুর রেললাইনের বেড়াডাকুরি পশ্চিম পাড়ায় ফিসপ্লেট উঠিয়ে হবি ও তার দলবল নাশকতার চেষ্টা চালায়। বাধা দিলে পুলিশের উপর চড়াও হয়। বোমা ফাটিয়ে পুলিশকে বিতাড়িত করে। উপরোক্ত সবকটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। একটি ডিবি এবং আরেকটি সিআইডি তদন্ত করে। পুলিশ চার মামলায় আদালতে চার্জশিট দিয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ারা নিয়ে হবি ও তার দলবল প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অপরাধ করে ফিরছে। প্রায়ই বেড়াডাকুরি পূর্বপাড়ার ফকিন্নি মোড়ের মাদ্রাসা সংলগ্ন চায়ের দোকানে অথবা বেড়াডাকুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। অথচ থানা পুলিশ বলছে আসামীরা ফেরার।
এ ব্যাপারে ঝাওয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, সরকার বিরোধী আন্দোলন সফল করার নামে বিএনপির এক শ্রেণীর নেতা এসব পেশাদার ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এরা দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে। রাতের অন্ধকারে সশস্ত্র মহড়া দেয়। এদের গ্রেফতার না করায় সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার জানান, ওরা পেশাগত ডাকাত, খুনি ও সন্ত্রাসী। ওদের কাছে বেশ ক’টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এছাড়া তাদেও সাথে রয়েছে জামাত-শিবিরের ক্যাডারা। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি ঝাওয়াইল ইউনিয়নে প্রায় সহ¯্রাধিক বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর, হামলা, লুট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। বহু নেতাকর্মী একটানা পাঁচ বছর এলাকায় আসতে পারেনি। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমরা সেসবের প্রতিশোধ নেয়নি। বরং সহণশীল পরিবেশে আমরা সবাই যেন রাজনীতি করতে পারি সেজন্য চেষ্টা করেছি।
তাই গত ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে ও পরে গোপালপুর উপজেলায় বিশেষ করে ঝাওয়াইল ইউনিয়নে ডাকাত হবি বাহিনী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। যানবাহন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, সরকারি দলের নেতাকর্মীদের উপর হামলা, রেললাইনের ফিশপ্লেট তুলে নাশকতা, পুলিশের উপর হামলাসহ হেনকোনো ক্রাইম নেই যা করেনি। সরকার বিরোধী আন্দোলনের নামে ওরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা করছে। গাড়ি ও যানবাহন পুড়িয়ে দিচ্ছে। জানমালের ক্ষতি করছে। সম্পদ লুট করছে। আমরা খুনোখুনি করে এসবের মোকাবেলা করতে চাই না। ওদের মত ঘৃণ্য দুস্কৃতীকারিদের গ্রেফতার ও শাস্তির মাধ্যমে জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই।
এ ব্যাপারে গোপালপুর থানা পুলিশের জানায়, ডাকাত হাবিবুর ও তার দলবলকে বাগে পেলেই গ্রেফতার করা হবে।