‘কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া’ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস আজ
হাসান সিকদার ॥
শোনো গো দখিন হাওয়া/প্রেম করেছি আমি…। প্রেম করার দারুণ সময় এখন। ভালোবাসার মহা অনুভূতির কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার দিনটি এসেছে। শাশ্বত প্রেমের কাছে নত হওয়ার ১৪ ফেব্রুয়ারি আজ। আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো- তোমার/ মনের মন্দিরে…।’ লেখা হয়েছে কি প্রিয় নাম? বলা হয়েছে, ‘ভালোবাসি’? আজ বলুন। ভালোবাসার শক্তিতে সুন্দর সমাজ, প্রেমময় পৃথিবী গড়ার শপথ নেয়ার আজই তো দিন। আজ ভালোবাসার নেশায় নতুন করে বুঁদ হবে হৃদয়। সারা দেশের মতো টাঙ্গাইলেও উদ্যাপিত হয়েছে ভ্যালেন্টাইন ডে। প্রেমিক- প্রেমিকারা একে অন্যকে বিভিন্ন উপহার দেয়া। মোবাইল ফোন, এসএমএস, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে হয়েছে ভালোবাসার আদান-প্রদান। প্রেমিকের হাত হয়ে প্রেমিকার সুবিন্যস্ত খোঁপায় উঠেছে লাল গোলাপ।
কিন্তু যে ভালোবাসা নিয়ে এত কথা, সেই ভালোবাসা আসলে কী? ‘প্রেম’ কাকে বলে? এসব প্রশ্নের উত্তর অনন্ত কাল ধরে খোঁজা হচ্ছে। সহজ কোনো উত্তর নেই। হয় না। কবিগুরু তাই হয়তো লিখেছিলেন, ‘যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।/কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম…।’ অন্যদিকে, যারা নামটি জানেন। তবে তাকে বলতে পারেন না ‘ভালোবাসি’, সেই তাদের ব্যথা তুলে ধরে কবিগুরু লিখেছেন: ‘আমি যে আর সইতে পারি নে।/সুরে বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারি নে।’ অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘লাগে বুকে সুখে দুখে কত যে ব্যথা,/কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা…।’
প্রেমের কবি নজরুল প্রিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে গেয়েছিলেন: ‘চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়ন পানে/ জানিতে নাইকো বাকি, সই ও আঁখি কি যাদু জানে।’
ভাটিবাংলার সাধক কবি হাছন রাজাও প্রেমে পড়েছিলেন। তীব্র সেই অনুভূতির কথা জানিয়ে তিনি গেয়েছিলেন: ‘নিশা লাগিলরে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলরে…।’ তার ‘নিশা’ আর কাটেনি কোনোদিন। বরং অনলে পুড়েছে ভেতর-বাহির। কাউকে বলে তা বোঝাবার নয়। সুনামগঞ্জের অসহায় প্রেমিক কবি তাই সুরে সুরে বলেছিলেন, ‘ধাক্ ধাক্ কইরা উঠল আগুন ধৈল আমার প্রাণে/সুরমা নদীর জল দিলে নিভে না সে কেনে…।’ আর রাধারমনের তো প্রাণ যায় অবস্থা! তিনি গাইলেন, ‘আমি রব না রব না গৃহে বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না…।’ প্রায় একই উচ্চারণ শাহ আবদুল করিমের কণ্ঠে। তাঁর বলাটিÑ ‘আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা/ কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া…।’ মনের মানুষ ছাড়া সত্যি বাঁচা দায়। ভালবাসাহীন জীবন বিবর্ণ। আর তাই যত আকুলি বিকুলি সব ভালোবাসার জন্য।
দিবসের কথায় ফেরা যাক, প্রথম দিকে দিবসটি ঘিরে কিছুটা ফিস ফাস ছিল। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে আসা। তাই ভ্যালেনটাইন ডে নিয়ে কিছুটা দ্বিধা দেখা গেছে এক সময়। এখন আর তা নয়। বিপুল আবেগ উচ্ছলতায় কাটে বিশেষ এই দিবস। ভালোবাসা দিবসে নতুন করে দেখা দেয় চিত্ত চাঞ্চল্য। রাজপথে, ক্যাম্পাসে, পার্কে, রেস্তরাঁয় মিলিত হয় যুগলেরা। শহর ঘুরে বেড়ায়। এবারও অভিন্ন উদ্যাপন দেখা যাবে।
তবে ভ্যালেন্টাইন ডে শুধু উদ্যাপনের নয়, মনের পুরনো অনেক ব্যথাও এ দিনটি জাগিয়ে দেয়। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’ ‘ঝরা ফুল’ কুড়ান প্রাক্তনরা। একসঙ্গে ছিলেন। এখন নেই। তবু স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। ফিরে পেতে চান ফেলে আসা দিন। ভয়ঙ্কর হাহাকার নিয়ে শহর ঘুরে বেড়ান। একা। কে বলবে, এই বিচ্ছেদ হয়তো আরও বড় প্রেম। গভীর ভালোবাসা।
স্থূল প্রেমও কম দেখা যায় না আজকাল। তরুণ-তরুণীরা যখন তখন প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। তার পর বিনা কারণে কিংবা সামান্য কারণে বলে দিচ্ছে ব্রেকআপ! নতুন প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাও জুটে যাচ্ছে তৎক্ষণাৎ। শুরু হয়ে যাচ্ছে ভালবাসাবাসি!
তবে আজ পোশাকী প্রেমের কথা হবে না। বরং যে প্রেম প্রেমের অধিক, সে প্রেমের আলোচনা হবে। শিরি-ফরহাদ, লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রোমিও-জুলিয়েটের মতো অমর হওয়ার স্বপ্নে উদ্যাপিত হবে ভ্যালেন্টাইন ডে।
যতদূর তথ্য, এই ভ্যালেন্টাইন ডে উদ্যাপনের শুরুটা প্রাচীন রোমে। তখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিয়ের দেবী জুনোকে সম্মান জানানোর পবিত্র দিন। দিবসটি অনুসরণ করে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করা হতো লুপারকেলিয়া উৎসব। সে সময় তরুণ-তরুণীদের খোলামেলা দেখা-সাক্ষাতের তেমন সুযোগ ছিল না। জীবনসঙ্গী নির্বাচনে তাদের জন্য ছিল লটারির মতো একটি আয়োজন। উৎসবের সন্ধ্যায় বেশকিছু কাগজের টুকরায় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে রাখা হতো। একটি করে কাগজের টুকরা তুলত তরুণরা।
কাগজের গায়ে যার নাম লেখা থাকত তাকে সঙ্গী হিসেবে পেত তরুণটি। কখনো কখনো ওই দুজনের মিলনের ক্ষণ এক বছর স্থায়ী হতো। কখনো কখনো তা গড়াত বিয়েতে। অপর গল্পটি এ রকমÑ স¤্রাট ক্লদিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার সেনাবাহিনীতে সৈন্য কম ভর্তি হওয়ায় ক্লদিয়াস উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি ধারণা করতেন, পরিবার ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই যুদ্ধে যেতে রাজি হতো না পুরুষরা। ফলে ক্লদিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময় রোমে ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন।
তিনি এবং সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন, বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা করতেন। এ অপরাধে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। বন্দি থাকাবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেত। জানালা দিয়ে তার উদ্দেশ্যে চিরকুট ও ফুল ছুড়ে দিত। হাত নেড়ে জানান দিত, তারা যুদ্ধ নয়, ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখে। এদের মধ্যে একজন আবার ছিল কারারক্ষীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতেন। একপর্যায়ে তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে যান।
ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সেদিনই ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। কালের ধারাবাহিকতায় আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
Comments are closed.