কালিহাতীতে পাকা ধানে আগুন দিয়ে কৃষকের অভিনব প্রতিবাদ
কাজল আর্য্য ॥
টাঙ্গাইলে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫’শ টাকায়। আর একজন শ্রমিকের দিন মজুরি ৮৫০ টাকা। এতে প্রতি মণ ধানে কৃষককে গুনতে হচ্ছে লোকসান। ফলে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আব্দুল মালেক সিকদার নামের এক কৃষক নিজের খেতের পাকা ধানে আগুন দিয়ে অভিনব প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
রোববার (১২ মে) দুপুরে উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা এলাকায় তিনি ধান ক্ষেত্রে পেট্টোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। প্রতিবাদকারী ওই কৃষক একই গ্রামের ওয়াজেদ আলী মাষ্টারের ছেলে। মালেক সিকদারের এই প্রতিবাদে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন এলাকার অধিকাংশ কৃষকরা। পাকা ধানে আগুন দেখে অনেকেই ছুটে আসেন। এ সময় স্থানীয়রা খেতে গিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
এ বিষয়ে কৃষক মালেক সিকদার টিনিউজকে বলেন, প্রতিমণ ধানের দাম থেকে প্রতি শ্রমিকের মজুরির দাম দ্বিগুণ। এবার ধান আবাদ করে আমরা মাঠে মারা পড়েছি। তাই মনের দু:খে পাকা ধানে আগুন দিয়েছি। তিনি আরো বলেন, সারাদেশের কৃষকদের পক্ষ থেকে তিনি এ অভিনব প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছেন। কেননা, বাজারে প্রতিমন ধান বিক্রি হচ্ছে পাঁচশত থেকে সাড়ে পাঁচশত টাকা দরে। আর কিন্তু এক মন ধান ফলাতে তার মোট খরচ হয়েছে হাজার টাকার উপরে। বর্তমানে ধান কাটা শ্রমিকের মূল্য আটশত থেকে সাড়ে আটশত টাকা। একজন শ্রমিক দিনে এক থেকে দেড় মন ধান কাটতে পারে। তাই কোন উপায় না দেখে আমি দেশের কৃষকদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ হিসেবে নিজের পাকা ধান খেতে আগুন লাগিয়ে এর প্রতিবাদ করেছি। অন্যদিকে বেশি মজুরি হলেও কামলা পাওয়া যায় না। খেতে ধান পাকলেও তা ঘরে তুলতে পারছি না। তাই এক দাগের ৫৬ শতাংশ খেতের ধানে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি। একই সাথে আমি ধানের দামের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এদিকে কালিহাতীর আউলটিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান মজনু নামের আরেক কৃষক তার খেতের পাকা ধান এলাকাবাসীকে বিনামূল্যে দিয়ে দিয়েছেন। এলাকাবাসী ধান কেটে অর্ধেক অংশ নিজে এবং বাকি অর্ধেক অংশ খেত মালিককে দিয়ে দিচ্ছেন।
এদিকে জেলার বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকায়। শ্রমিকের দিন মজুরীর ৯’শ থেকে এক হাজার টাকা। রকিবুল ইসলাম নামের এক চাষী টিনিউজকে বলেন, বীজতলা থেকে শুরু করে প্রতি মণ ধান ঘরে তুলতে হাজার টাকার উপরে খরচ হয়। কিন্তু ধান বিক্রি করছি তার অর্ধেক দামে। এবার আমরা পথে বসে গেছি। এছাড়া আরো কয়েকজন কৃষক আক্ষেপ করে টিনিউজকে বলেন, কৃষককে ধানের ন্যায্য দাম দিয়ে বাঁচাতে হলে সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন।
এদিকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার এলেঙ্গাতে শ্রমিকের হাটে রোববার (১২ মে) সকালে রংপুর থেকে আসা একজন শ্রমিক ৮’শ থেকে ৯’শ টাকায় প্রতিদিনের জন্য বিক্রি হচ্ছে। সেইসাথে তাদেরকে ধানের জমির মালিকে তিন বেলা খাবারো দিতে হবে। কৃষি নিয়ে কাজ করা এনজিও কর্মকর্তা কামরুল হাসান টিনিউজকে বলেন, বর্তমানে কৃষকদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। লাভতো দূরের কথা, ধান চাষ করে কৃষক আর্থিকভাবে বিপুল পরিমান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিষয়টি সরকারের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজাদ হোসেন পাকা ধান ক্ষেত্রে আগুন দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে টিনিউজকে বলেন, এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা। কৃষকদের ধানের ন্যায্যমূল্য দেয়া উচিত। কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হলে দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
এ বিষয়ে কালিহাতী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এএম শহীদুল ইসলাম টিনিউজকে বলেন, জমিতে আগুন লাগার বিষয়টি শুনেছি লোকমুখে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলে সঠিক তথ্য দিতে পারবো। প্রতি বিঘা জমিতে ধানের উৎপাদন খরচ ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা। আর ধানের বর্তমান বাজার মূল্যে প্রতি বিঘায় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা কৃষকের লোকসান হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারকে কৃষি কাজে যান্ত্রিকীকরণ ও ভর্তুকির পরিমান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবেই কৃষক উপকৃত হবে।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত জেলায় প্রায় ৩০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। বাকী ৭০ শতাংশ কিন্তু ধান পেকে গেলেও কৃষক দিন মজুরের অভাবে ঘরে তুলতে পারছে না। দিন প্রতি একজন দিনমজুরকে দিতে হয় ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। আবার কোন কোন জায়গায় এক হাজার টাকা পর্যন্ত। আর বর্তমান বাজারে ধানের মূল্যে ৫০০ টাকা মন। এতে প্রায় দুই মন ধান বিক্রি করে কৃষক একজন দিনমজুরকে (কামলা) মজুরি দিতে হচ্ছে। আবার অধিক মজুরি দিয়েও দিনমজুর পাচ্ছেন না কৃষকরা। ফলে জমিতে পাকা ধান জমিতে পড়েই নষ্ট হচ্ছে।
টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক টিনিউজকে বলেন, এই সময়ে ধানের বাজার কিছুটা কম থাকলেও কৃষক যদি ধান সংরক্ষণ করে রাখে তবে ক’দিন পরেই অধিক মূল্য পাবে। তাপদাহসহ নানা কারণে কিছুটা শ্রমিক সংকট থাকলেও তা তীব্র নয়। জেলায় এরই মধ্যে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭০২ হেক্টর জমির ধানের প্রায় ৩০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে।