করোনায় বদলে গেছে টাঙ্গাইলের মানুষের জীবনাচার

160

জাহিদ হাসান ॥
মুখে মাস্ক। চোখে চশমা। তারপর আবার ঢাকনা ওয়ালা গ্লাস। হাতে গ্লাভস। গায়ে পিপি। মাথা কখনও খোলা থাকলে তাও ঢাকনা দিয়ে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা। করোনা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে এটাই এখন বদলে যাওয়ার প্রচ্ছদ। অর্থাৎ পরিচিত বা অতিপ্রিয় মানুষ একজন আরেকজনকে দেখে চেনার কোন উপায় নেই। হয়তো পাশ দিয়েই যাচ্ছেন। আগে প্রতিদিন কথা হতো। হতো কুশল বিনিময়। এখন আর তেমনটি কমই হয়। যে যার মতো করে বদলে যাওয়া জীবন নিয়ে চলছেন। চোখ আর কণ্ঠস্বর হয়তো কোন কোন সময় পরিচিত জনের পথচলার আভাস দেয়। চেনার পথ তৈরি করে। অর্থাৎ করোনায় বদলে গেছে টাঙ্গাইলের মানুষের জীবনাচার।
এত গেল নিজেকে সুরক্ষিত রাখার একটি পর্ব। আরেকটি পর্ব হলো ঘরে-বাইরের। একটু পরপর হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার মাখা থেকে শুরু করে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পথচলা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী এখন অনেকেই ঘরে মাস্ক পরতে শুরু করেছেন। কারণ ঘরে থেকেও আক্রান্ত হচ্ছেন কেউ কেউ। আবার যারা অফিস করছেন তাদেরও নিজেকে নিরাপদ রাখতে চেষ্টার যেন কোন শেষ নেই।
করোনাকালে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে বিরাট পরিবর্তন। ভিটামিন সি যুক্ত খাবার এখন সবাই বেশি করে খাচ্ছেন। ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে শুরু করে নামী-দামী হোটেল রেস্টুরেন্টে বেচাকেনা কমেছে আশঙ্কাজনকহারে। করোনা থেকে বাঁচতে লবণযুক্ত গরম পানির গরগরা, গরম পানি খাওয়া, লেবুর শরবত, মৌসুমি ফল, সবজি বেশি বেশি খাচ্ছেন বেশিরভাগ মানুষ। আবার বাজারে কম গিয়ে কিভাবে চলা যায় সে অভ্যাসও ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে। একদিন বাজারে গিয়ে অন্তত ১৫ দিনের প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে আনছেন।
এর বাইরেও রান্তায় কোন অবস্থাতেই থু থু ফেলা যাবে না। হাচি বা কাঁশি দেয়ার সময় কনুই ভাজ করে বা নাকে-মুখে রুমাল চেপে দিতে হবে। ব্যবহৃত জিনিসপত্র সাবান দিয়ে ধোয়া মোছা বাধ্যতামূলক। ঘার-বাড়িসহ অফিস পরিষ্কার রাখা। ব্যবহৃত মাস্ক ও গ্লাভস ফেলতে হবে ডাস্টবিনে। বারবার হাত ধুতে হবে ২০ সেকেন্ড। প্রয়োজনের তাগিদেই এসব কিছু করতে হচ্ছে। মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দেদার বিক্রি বেড়েছে সুরক্ষা সামগ্রীর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোটা বিশ^কে থামকে দিয়েছে প্রাণঘাতী করোনা। তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও বদলে যাওয়া জীবনে মানুষকে অভ্যস্থ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অনভ্যাসকে পরিণত করতে হবে অভ্যাসে। মানিয়ে নিতে হবে একা থাকা ও চলা। করোনার ছোবলেও মধ্যে আসলে কেমন করে বদলে গেলাম। কতটা বদলে গেলাম। তাছাড়া বদলে যাওয়ার ধারাবাহিকতাও কি ধরে রাখা সম্ভব। কতটা রয়েছে মানসিক প্রস্তুতি বা সমাজে বদলে যাওয়ার চিত্র। টাঙ্গাইলে এখন পর্যন্ত ৭৪৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১৬ জন। টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাঁচার প্রয়োজনে এখন অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে পথ চলেন। যদিও উল্টো চিত্রও দেখা যায়। তবে মেনে চলার সংখ্যাই বেশি। কতটা মানছেন তারা বা পারছেন?
একটি বেসরকারী ব্যাংকে চাকরি করেন হামিদুল রহমান। প্রতিদিন অফিসে যেতে হয়। করোনা রোধে মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস, আই গ্লাসসহ সব ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করেন তিনি। তিনি টিনিউজকে বলেন, এখন পরিচিতজনদের সহজে চেনার কোন উপায় নেই। করোনায় বদল দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। তিনি বলেন, আমরা দুই বন্ধু একসঙ্গে প্রায়ই অফিস যেতাম। এখন এমন সময় হয় ও পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও চিনতে পারি না। চোখ আর কণ্ঠস্বর বন্ধুত্বের জানান দেয় অনেক সময়। ছয়আনী বাজারের ব্যবসায়ী কুরবান মিয়া টিনিউজকে জানালেন, করোনায় মানুষের চেহারা, পোশাক ও চলনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। কাছের লোকদের সহজে চিনতে পারি না। তিনি মজা করে বলছিলেন, সম্প্রতি আমার ছেলে সুরক্ষা সামগ্রী পরে দোকানে জিনিস কিনতে আসে। আমি অন্যমনস্ক হয়ে টাকা রেখে সদাই বিক্রি করি। ছেলে যাবার সময় আমাকে বলে আব্বা তুমি আমার থেকেও রাখলে? শহরের একটি বেসরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জিয়াউর। তিনি টিনিউজকে জানালেন, কোভিড থেকে বাঁচতে জীবনযাত্রার সঙ্গে এখন পোশাকের ব্যবহার বদলে গেছে। বাসায় শিশুরা শরীর ঢাকা পোশাক দেখে অনেক সময় ভয় পায়। বাইরে প্রতিদিন যেতে হয়। তাই বাসায় ফেরার পর মুখে মাস্ক থাকে। সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য একটু দূরে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু এতে তারা মনে মনে কষ্ট পায়।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মাস্ক, গ¬াসের কারণে মানুষের মুখমন্ডল করোনায় চেনা কঠিন হয়ে গেছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত আসামি ধরতেও হিমশিম খাচ্ছে। এখন সমাজের সব স্তরের মানুষই নিজেকে সুরক্ষিত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনা প্রতিরোধে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে যেসব অভ্যাস গড়ে উঠেছে তা থেকে সহজেই মুক্তির কোন সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ মুখে মাস্ক, হাত ধোয়া, পিপিই গায়ে দিয়ে পথ চলতে হবে। বারবার সাবান পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়া ও খাদ্যাভাস হবে নতুন নিয়মে। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। আমরা বিশ্বাস করি সঙ্কট কেটে যাবে। কিন্তু কত সময় লাগবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। অনেক দেশে আক্রান্ত কমে গিয়ে ফের বাড়ছে। তাই কিছুটা কমলে নিজেকে আগের অবস্থায় নেয়া যাবে না। সর্বোচ্চ সচেতন থেকে চলতে হবে।