ঋতুরাজ বসন্তের দিনে ভালোবাসার ছোঁয়া

121

জাহিদ হাসান ॥
বাতাসে শীতের সেই তীব্রতা নেই। নেই কুয়াশার ধূসর আচ্ছাদন। স্নিগ্ধ কোমল পরশ জানান দিচ্ছে এসে গেছে বসন্ত। গাছে গাছে সবুজ কিশলয়। ডালে ডালে মঞ্জরিত নতুন ফুলদল। শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার বর্ণিল আভা রাঙিয়ে দিচ্ছে বিরহ ক্লান্ত মন। দূরের দিগন্ত থেকে ভেসে আসছে কোকিলের কুহুকুহু কলতান। ম-ম ঘ্রাণ ছড়িয়ে ডালে ডালে অঙ্কুরিত আম্র্রমুকুল। রঙিন ডানায় ফুলের পরাগ মেখে হাওয়ায় হাওয়ায় দোল দিচ্ছে বর্ণিল প্রজাপতি। প্রতিটি ঋতুর শেষে প্রকৃতি তার পুরোনো অবয়ব থেকে এভাবেই বাঁক নেয় নতুন আবাহনে। ষড়ঋতুর লীলা চাতুর্য ভরা এটিই বাংলার চিরন্তন রূপ। এই রূপ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষও বদলে যায়। বদলে যায় তাদের জীবন। ফিরে পায় নতুন চঞ্চলতা।




বসন্ত ঋতুর প্রথম দিন পহেলা ফাল্গুন মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি)। ফাল্গুন মাসের প্রথম দিনটিতে বাঙালি মেতে ওঠে বসন্ত উৎসবে। তাতে প্রাণে প্রাণ যোগ করে প্রকৃতি ও মানুষ। সহজাতভাবে পরিস্ফুটিত হয় ফুল, পাখি ও নারী। সুরে ও ছন্দে আনন্দের রিনিক-ঝিনিক মাদল বাজায় বসন্ত। বসন্তের রং হলুদ। তার সঙ্গে লাল ও কমলার নিবিড় বন্ধন। মাঘের শীত ঘুম পাড়িয়ে রাখলেও ফাল্গুগুনের প্রথম দিনের ভোরে ঘরের বাইরে পা দিলেই বাসন্তী হাওয়া এসে জানিয়ে দিয়ে যায় ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে…।’




চারপাশে বাসন্তী রঙের ছড়াছড়ি। মেয়েদের পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি। কপালে লাল টিপ। রঙ মিলিয়ে হাতভর্তি কাচের চুড়ি, গলায় পুঁতির মালা। চোখে, ঠোঁটে, মুখে এমনকি হাতের ব্যাগেও রঙিন ছোঁয়া। হারিয়ে যেতে বসা খোঁপায় বা বিনুনিতে গাঁদা ফুলের মালা। তবে একদম বাসন্তী সাজে সাজা সম্ভব না হলেও হলুদের কাছাকাছি বসন কিংবা শরীরের কোথাও না কোথাও এক টুকরো হলুদ নিশানা থাকেই। সে শাড়ি হোক কিংবা সালোয়ার-কামিজ। হালে ফ্যাশন সচেতন বাঙালির বসন্তের পোশাক-আশাকে লেগেছে নানা নকশা ও আলপনার বাহার। কারো কারো হাতে থাকে ফুল। সে সঙ্গে অবয়বজুড়ে লেগে থাকে বাঁধনহারা হাসি।




বসন্তের সৌরভ নিয়ে বর্ণিল সাজে মোহনীয় বাঙালি নারীর পাশাপাশি তরুণরাও নানা রঙের পাঞ্জাবি, ফতুয়া ও কাঁধে নানাবর্ণের চাদর ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ হাতে জড়িয়ে নেয় বেলি কিংবা গাঁদা ফুলের মালা। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বসন্তের রঙে সবাই নিজেকে রাঙিয়ে নেয়। প্রাণে প্রাণে দোলা দেয় নতুন আবেশ। হৃদয়ের ব্যাকুল তন্ত্রিতে তখন আপনিতে বেজে ওঠে- আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়…।




বসন্ত উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব। বর্ষবরণ, নবান্ন উৎসব, পৌষমেলা- এসবের মতো বসন্ত উৎসবও বাঙালি চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহনশীলতা। দৃঢ়তর হয় মৈত্রীর বন্ধন। শুধু রাজধানীতে নয়, দেশজুড়ে বসন্তের আবাহনে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান। প্রকৃতি আর মানুষের এই মিলনমেলা গোটা দেশকে মাতিয়ে তোলে আনন্দ হিল্লোলে। ইথারে ইথারে তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার ঘরে ঘরে।




বসন্তে সংযোজন ঘটেছে ভ্যালেন্টাইনস ডে অর্থাৎ ভালোবাসা দিবস। বসন্তকালে হওয়ায় বাঙালি এই দিনটিকে লুফে নিয়েছে। মন কেমন করা ঝিরিঝিরি উদাসী হাওয়া, পাখপাখালির কূজন ও হাজারো রঙের খেলা নিয়ে প্রকৃতির যে আনন্দ বিহার তাতে ভালোবাসা থাকবে না, তা কী করে হয়? ভ্যালেন্টাইনস ডে না থাকলেও আমাদের বসন্তই তো ভালোবাসা দিবস।

Comments are closed.

ব্রেকিং নিউজঃ